যেন কোনদিন খায়নি, দেখেনি-ঠিক এরকম অবস্থা। কার আগে কে নেবে- এ এক হুলস্থুল অবস্থা। অবশ্য খায়নি যে এটাও ঠিক। এই সাইজের জিলাপী খুব কমই খাওয়া হয়েছে এদের। সচরাচর দোকানে যে জিলাপী পাওয়া যায় এই জিলাপী সাইজ ও স্বাদে তার চেয়ে আলাদা। এই গ্রামে সে রকম জিলাপী কেউ বানায় ও না। খালিদ সাহেব বছরের মাঝে-মধ্যে গ্রামে এসে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেন। দোয়া শেষে তাবাররুকের ব্যবস্থা করেন। এবারও তাই করলেন। তবে তাবাররুকের আয়োজন যেন অন্যবাবের চেয়ে একটু ভিন্ন। এবারের তাবাররুকের প্যাকেটের বিশেষ একটা আইটেম শাহী জিলাপী। স্বাদে অসাধারণ। বেশ কিছুদিন ধরে খালিদ সাহেবের ব্যবসা মন্দ যাচ্ছিল, শুধু খালিদ সাহেব না: কারো ব্যবসা ভালো যাচ্ছিল না। অনেকটা হঠাৎ করে খালিদ সাহেবের ব্যবসায় লাভের ফুল ফুটলো। তাই তিনি গ্রামে এসে মিলাদ মাহফিল করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।
মসজিদ জুড়ে যে চেঁচামেচি হচ্ছে তাতে কারো বোঝার উপায় নেই, এটা কি মসজিদ নাকি মাছের বাজার। কারো চোখ বেঁধে যদি এখানে নিয়ে আসা হয় সে নিশ্চিত ধরে নেবে এটা মাছের বাজার। এখন তো তাবাররুকের জন্য এই চেঁচামেচি; সপ্তাহের জুমাবারেও এই ধরণের চেঁচামেচি হয়। একদিকে ইমাম সাহেব জুমার খুতবা পাঠরত। অপরদিকে উঠতি বয়সী ছেলেদের গালগল্প! যেন গল্পের জন্য এটাই শ্রেষ্ঠ সময় শ্রেষ্ঠ স্থান! কিছুদিন আগেও জুমার খুতবা শুনতে এসে একে অপরকে জিজ্ঞেস করত- এ্যাই আজকের বাংলা সিনেমার নাম যেন কী? আর এখন তো দেশ অনেক এগিয়েছে! বাংলা সিনেমার প্রতি কমে গেছে ঝোঁক। খুতবা শুনতে এসে ব্লু-টুথের মাধ্যমে পরস্পরে ডাটা ট্রান্সফার করে! দোয়া শেষে তাবাররুক বিতরণ চলছে। খালিদ সাহেব একটা ব্যাপার বেশ কিছুক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাবারুকের প্যাকেট নেয়ার জন্য অন্যদের মত একটা ছোট ছেলেও একবার এদিকে যায়, আরেকবার ওদিকে যায়। কিন্তু কিছুতেই নিতে পারছে না। ছেলেটার চেহারার সাথে খুবই আপনজন কারো চেহারার যেন মিল আছে। ঠিক মনে করতে পারছেন না খালিদ সাহেব। ভিড় আর ঠেলাঠেলির কারণে নিতে গিয়ে ও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।
অবশেষে একটা প্যাকেট পেল। প্যাকেট হাতে নেয়ার পরপরই খুলে তা থেকে জিলাপী বের করে মুখে দিল। মুখে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কার সাথে যেন ধাক্কা লেগে জিলাপীটা পড়ে গেল। পড়ল তো পড়ল একেবারে মসজিদ নির্মাণের জন্য আনা বালির ওপর। এটা দেখে খালিদ সাহেব যেন পুরনো স্মৃতিতে ডুব দিলেন। জিলাপীর জন্য কত কিনা করেছেন, এখন ভাবতেই লজ্জা লাগছে। লজ্জার ভাবটাও তার চেহারায় পুরোপুরি এসে গেছে। তখন বয়স আট কি নয়। একবার বড়ভাইয়ের সাথে চায়ের দোকানে গিয়েছিলেন। বড় ভাইয়ের বেশ ক’জন বন্ধুসহ ছিল। বন্ধুরাসহ বড়ভাই আড্ডা দেয়ার পর চা-দোকানে গেল। সেখানে অন্য নাস্তার সাথে জিলাপীও ছিল। সবাই খাচ্ছিল যে যার মত করে।
খালিদ সাহেবও অন্যদের মত খাচ্ছিল। একটা খাওয়ার পর আরেকটা হাতে নিল। সেটা শেষ করে আরেকটা নিতে যাবে এমন সময় বড় ভাই খালিদ সাহেবের গায়ে চিমটি কাটলেন। খালিদ সাহেব ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। তিনি জিলাপীটা আবার নিতে যাবেন এমন সময় বড় ভাই হাতের কনুই দিয়ে হালকা ধাক্কা দিলেন। এরপর যা বোঝার বুঝে নিলেন। ঐ দিন জিলাপীটা খাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বড় ভাইয়ের বাঁধায় পারেননি। আরেকবারের ঘটনা। পাশের মাদ্রাসায় এক বড় হুজুরের ঈসালে সাওয়াব মাহফিল চলছিল।
সন্ধ্যার পর খালিদ সাহেব তার ভাগ্নেকে নিয়ে মাহফিলে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন মাহফিলে জিলাপী দেওয়া হবে। যা মাহফিলে অবধারিতভাবে দেওয়া হয়। মাহফিল শেষ হতে দেরি দেখে তিনি চলে এলেন। রাতের খানাপিনা শেষ হওয়ার পর বড় ভাই বাড়ির সবার সামনে তাকে বললেন- তুমি মাহফিলে গিয়েছিলে না? ভেবেছিলে জিলাপী দেবে, ততক্ষণ তো ধৈর্য ধরে বসতে পারনি। খালিদ সাহেব সেদিন বড় ভাইয়ের কথা শুনে হতবাক হয়েছিলেন। কারণ তিনি তার সঙ্গী ভাগ্নেকেও জিলাপীর কথা একবারের জন্যও বলেননি। বাড়ির কেউ তো দূরের কথা। এসব ভাবতে ভাবতে খালিদ সাহেব ছেলেটির কাছে গেলেন। ছেলেটির চোখ তখনও বালির উপর পড়ে থাকা জিলাপীর ওপর।
ছেলেটির কাছে যেতেই বললেন- : তুমি কার ছেলে? : ড্রাইভার নুরুর ছেলে। ড্রাইভার নুরু বলার সাথে সাথে খালিদ সাহেব গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন। নুরুর স্ত্রী ছিল খালিদ সাহেবের প্রিয় এক মানুষ। তার সাথে ছিল মন দেয়া নেয়ার এক গভীর সম্পর্ক। তিনি ভেবেছিলেন তাকেই জীবন সঙ্গীনি করে নেবেন। মনে-প্রাণে এ ইচ্ছা লালন করে এলেও পরিবারের কারণে সেটা পূরণ হয়নি। বাবা তাদের পরিবারটাকে মোটেও পছন্দ করতেন না। বাবার এক কথা ছিল- ওকে বিয়ে করলে এ ঘরে তোর আর স্থান নেই। কঠিন এই আদেশ পালন করতে গিয়ে জীবন থেকে হারাতে হয়েছিল ওকে। ওর পরিবারও মেয়েকে বিয়ে দিতে দেরি করেনি। একই গ্রামের নুরুর সাথে ঘটা করে বিয়ে বসায়। যেন খালিদ সাহেবের উপর এক মনস্তাত্ত্বিক প্রতিশোধ। সে বছর দশেক আগের কথা। খালিদ সাহেব সে সব স্মৃতি অনেকটা ভুলে যেতে বসেছেন সংসার ব্যবসার ব্যস্ততার কারণে।
এসব মনে করে নতুন করে জ্বালা নিতে চাইছেন না। : ছেলেটি কাছে এলে খালিদ সাহেব তাকে বললেন- : তোমাদের ঘরে কে কে আছে? : মা-বাবা ও আমরা দুই ভাই। খালিদ সাহেব ভাবছেন তার মা কেমন আছে জিজ্ঞেস করবেন কি না, কিন্তু বিবেকের কোন এক বাধায় তিনি তা পারলেন না। : জিলাপী কি তোমার খুবই পছন্দের? : হ্যাঁ, পছন্দ করি। আমারও পছন্দের, তোমার মত আমিও জিলাপীর জন্য অনেকটা পাগল ছিলাম- কথাটা এমনভাবে বললেন যেন নিজের ছেলেকে বলছেন। খালিদ সাহেবের কথা শুনে ছেলেটারও তাকে আপনজন মনে হতে লাগল। সে শান্ত ছেলের মত খালিদ সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। খালিদ সাহেব তাকে তাবাররুকের চারটা প্যাকেট হাতে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। নিজের পছন্দের জিনিস অন্যেরও পছন্দের বলে নাকি অন্যকোন টান থেকে ছেলেটাকে চারটা প্যাকেট দিলেন খালিদ সাহেব নিজেও ঠিক বুঝতে পারলেন না।