এক পলকের জন্যে চোখ মেলে প্রথমেই শকুনটাকে দেখতে পেল মাসুদ রানা, আকাশে ডানা মেলে উড়ছে, লম্বা গলা আরও লম্বা করে লোলুপদৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে সম্ভাব্য খোরাক হিসেবে ওকে বিবেচনা করা যায় কিনা। রোদে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ায় পাতা বন্ধ করে ফেলেছে, তারপরও শকুনটার কালো আকৃতি দেখতে পাচ্ছে ও। মুখের ভেতর পুরানো কাগজের কটু স্বাদ, কানে অস্পষ্ট ভনভন গুঞ্জন। জিভ অসম্ভব মোটা লাগছে, শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে গেছে ঠোঁট। ভয়-ভয় করছে ওর। বিমূঢ় ও হতভম্ব। এই জায়গাটা কোথায় ও জানে না। কি কারণে এখানে এভাবে পড়ে রয়েছে তাও বুঝতে পারছে না। এ তো দেখছি ভারি মুশকিল, কিছু মনে পড়ছে না কেন!
এবার একটু একটু করে, উজ্জ্বলতা সইয়ে নিয়ে চোখ মেলল ও। মাথার একপাশে সূর্য। মণি ঘোরাচ্ছে রানা। আছে, শকুনটা আছে। এটা একটা জঙ্গল। একটু দূরে প্রচুর গাছ। ও পড়ে রয়েছে ঘন একটা ঝোপের গায়ে। ভোঁতা, ভনভন আওয়াজটা এখনও বাজছে কানে। এবার চোখ নয়, ঘাড় ফেরাল। ওর কাছ থেকে প্রায় ত্রিশ গজ দূরে পড়ে রয়েছে প্রায়-বিধ্বস্ত ছোট একটা প্লেন। জায়গাটা ফাঁকা, তাই শুকনো ঝোপে আগুন লাগেনি। এক পলকে সব মনে পড়ে গেল রানার। টু-সিটার সেসনা নির্মেঘ আকাশ থেকে আহত ঈগলের মত খসে পড়েছিল। মাটির সঙ্গে সংঘর্ষের সময় প্লেনটা থেকে ছিটকে পড়ে ওর শরীর। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায় সেসনায়, হামাগুড়ি দিয়ে লেলিহান শিখাগুলোর নাগাল থেকে দূরে সরে আসে ও। এখনও ওটা থেকে একটু একটু ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
ভঙ্গিটা আড়ষ্ট-দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করছে—উঠে বসল রানা। ট্রাউজার ছিঁড়ে গেছে, উরুতে শুকনো মাটি লেগে রয়েছে। গায়ের শার্টটা এখন কয়েক ফালি কাপড় মাত্র, বাতাসে উড়ছে। কপালে হাত রেখে রোদ ঠেকাল, চারপাশটা আরেকবার ভাল করে দেখে নিচ্ছে। গভীর জঙ্গল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে সবুজ ঘাস মোড়া ফাঁকা জায়গায় রয়েছে ও, একটা ঝোপের গায়ে। না, সভ্যতার কোন চিহ্ন চোখে পড়ছে না।
সামনে দিয়ে স্যাঁৎ করে উড়ন্ত ছায়াটা চলে যেতেই আবার আকাশে তাকাল রানা। শকুনটাকে দেখে এবার বন্ধু জুলিয়াস কাইজার ওরফে জুলহাস কায়সারের কথা মনে পড়ে গেল ওর। ওকে জ্যান্ত দেখার পরও কিসের আশায় এখনও চক্কর দিচ্ছে ওটা? একটা কিছু অমঙ্গল আশঙ্কা করে রানার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।
বিরক্তিকর আওয়াজটা আগের চেয়ে জোরাল লাগছে কানে; এতক্ষণে উপলব্ধি করল, শব্দটা আসলে ওর মাথার ভেতর হচ্ছে না—ভেসে আসছে অকুস্থলের আরও কাছাকাছি কোথাও থেকে। একঝাঁক মাছি ভন-ভন করছে।
বিধ্বস্ত সেসনাকে কোন রকমে চেনা যাচ্ছে। ওই প্লেনে কায়সার ছিল। সে-ই চালাচ্ছিল ওটা। ধ্বংসসতূপের কোথাও তাকে দেখা যাচ্ছে না।
দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে যাবার উপক্রম করল রানা। পা টলছে। সারা শরীরে ব্যথা। তবে নেহাতই ভাগ্যের জোরে মানুষ প্লেন অ্যাক্সিডেন্টে বাঁচে। আর কিছু লোকের ভাগ্য চিরকালই বাকি সবার চেয়ে ভাল। আশ্চর্য, ওর একটা হাড়ও ভাঙেনি। বাম বাহুর লম্বা ক্ষতটা এরইমধ্যে শুকাতে শুরু করেছে। বিধ্বস্ত সেসনার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ও। কায়সারকে খুঁজে বের করতে হবে। দেখতে হবে সে বেঁচে আছে কি না।
প্লেনটার কাছে হেঁটে আসায় মাছির ভন-ভন আওয়াজটা বড় বেশি বিরক্ত করছে রানাকে। ঝুঁকে ককপিটের ভেতর তাকাতে চাইছে ও। কি দেখতে হবে জানে না, বুকের ভেতরটা ধক-ধক করছে। কিন্তু না, ককপিটে ওর বন্ধু কায়সার নেই। তলপেটের ভেতরটা খালি-খালি লাগছে। ধীর পায়ে হেঁটে ধ্বংসসতূপের সামনে চলে আসছে ভাঙা ডানা আর তোবড়ানো ফিউজিলাজকে পাশ কাটিয়ে। হঠাৎ স্থির হয়ে গেল রানা।
প্রায় দশ গজ দূরে রক্তাক্ত, থেঁতলানো মাংসের একটা বেঢপ সতূপকে কায়সার বলে চিনতে পেরেছে ও। ওর মত সে-ও ছিটকে দূরে পড়েছিল, তবে প্লেনটা ওর হাড় গুঁড়ো আর মাংস ছিঁড়ে নেয়ার আগে নয়। তার কপাল আর নাক-মুখ উইন্ডশীল্ডের ধাক্কায় খুলির ভেতর সেঁধিয়ে গেছে। ঘাড়টাও ভেঙে গেছে। কাপড়- চোপড় শত ছিনড়ব, সারা গায়ে শুকিয়ে কেক হয়ে গেছে রক্ত। বড় আকারের একদল ব্রাজিলিয়ান মাছি কমলা রঙের ফাটল, ফুটো ইত্যাদি দিয়ে ভেতরে ঢুকছে, বাকিরা লাশটাকে ঘিরে বিরতিহীন উড়ছে। বমি পাওয়ায় ঘুরতে যাবে, ফাঁকা জায়গার কিনারায় ঝোপের ভেতর কিছু একটা নড়ে ওঠায় স্থির হয়ে থাকল। লাশের পিছনের ওই ঝোপ থেকে অত্যন্ত ভীরু ভঙ্গি নিয়ে বেরিয়ে এলো একটা হায়েনা; চোখাচোখি হতে অন্যদিকে তাকাল, যেন লজ্জা পাচ্ছে, অথচ কাঁচা মাংসের গন্ধ পেয়ে হাঁ করা মুখের বাইরে বেরুনো জিভ থেকে লালা ঝরছে টপ-টপ করে, এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে এগিয়ে আসাটাও থামেনি।
অভিজ্ঞ শিকারী, এসবই আসলে হায়েনাটার অভিনয়। সে জানতে চায় জ্যান্ত লোকটা ওকে বাধা দেবে কি না। দিলে অস্ত্রটা কি হবে?
রানা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, দেখেই হায়েনা বুঝে নিল ও নিরস্ত্র। তারপর যা ঘটল, চোখের পলকে। সামান্য দূরত্ব এক নিমেষে পার হলো হায়েনা, লাশের একটা পাশ কামড়ে ধরে মাথা ঝাঁকিয়ে ছিঁড়ে নিল।
‘এই ভাগ! যা!’ খালি হাতেই তেড়ে গেল রানা, তবে আগুনটাকে পাশ কাটাবার সময় জ্বলন্ত একটা ডাল দেখতে পেয়ে তুলে নিল, ছুঁড়ে মারল জানোয়ারটার দিকে। ঝোপের এক দিক দিয়ে ঢুকে আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে ছুটে পালাল সেটা, মুখে কায়সারের এক টুকরো মাংস নিয়ে।
বেঢপ সতূপটার দিকে আবার তাকাল রানা। কায়সারকে এভাবে ফেলে রেখে যেতে কষ্ট হবে ওর। এই অচেনা জঙ্গলে কবর খোঁড়ার জন্যে কোথায় কোদাল পাবে ও। নাহ্, লাশটাকে পোকামাকড় আর শেয়াল-শকুনের খোরাক হিসেবে ফেলে রেখে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তারপরও কিসের আশায় কে বলবে বিধ্বস্ত প্লেনটার আশপাশে ঘুর-ঘুর করছে ও। কিছু হয়তো খুঁজছে।
চিন্তা করছে রানা। শেষ পর্যন্ত কায়সারের ধারণাটাই সত্যি প্রমাণিত হলো। তাকে ওরা ঠিকই সুযোগ তৈরি করে নিয়ে ধরেছে, অর্থাৎ মেরে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, কায়সারের সঙ্গে রানাকেও প্রায় খুন করে ফেলেছিল। বলতে হবে স্রেফ ভাগ্যের জোরে অন্তত এখন পর্যন্ত বেঁচে আছে ও। তবে ভাগ্যের সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটা সম্ভবত একটু পর সামনেই। আদিবাসীদের এলাকা থেকে বহাল তবিয়তে সভ্য জগতে ফিরে যাওয়া বড় কঠিন কাজ।
খুঁজলে হয়তো সত্যি সবই পাওয়া যায়। অন্তত এক্ষেত্রে রানার বেলায় সত্যি পাওয়া গেল ইস্পাতের একটা রড, ডগার দিকটা চ্যাপ্টা ও ধারাল। ঘাস মোড়া মাটি খুব নরম। এ-ও ভাগ্যের সহায়তা, তাছাড়া আর কি বলা যায়। পাথুরে মাটি হলে ক্লান্ত রানা কবরটা খুঁড়তে পারত কিনা সন্দেহ।
মাটি খুঁড়ছে রানা, আর ভাবছে। পাঁচ হাজার ফুট ওপরে, স্যাবটাজ-এর শিকার সেসনার এঞ্জিন খক খক কাশতে শুরু করার ঠিক আগে, কথায় কথায় কায়সার বলছিল কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা একটা ছোট্ট গ্রামের ওপর দিয়ে উড়ে যাবে। তার সেই কথা থেকে রানা আন্দাজ করছে, গ্রামটা অন্তত পঁচিশ থেকে ত্রিশ মাইল উত্তরে হবে। পানি ও অস্ত্র ছাড়া ওখানে পৌঁছানোর সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। হয় জংলী আদিবাসী, নয়তো হিংস্র কোন জানোয়ারের পেটে চলে যাবার আশঙ্কাই প্রবল।
দুপুর একটায়, এক নাগাড়ে দেড় ঘণ্টা মাটি খোঁড়ার পর, যথেষ্ট গভীর একটা কবর তৈরি করা সম্ভব হলো। গায়ের ছেঁড়া শার্ট খুলে লাশটাকে কোন রকমে জড়াল ও, তারপর প্রায় বুকে জড়িয়ে ধরে কবরের নিচে নামাল।
বন্ধুকে মাটি চাপা দেয়ার পর খানিকটা হেঁটে এসে প্রায় ওর সমান উঁচু একটা উইঢিবির গায়ে হেলান দিয়ে বসল রানা। মাত্র তিন দিন আগে ব্রাজিলের ব্রাজিলিয়া শহরে এক চীনা রেস্তোরাঁয় জুলহাস কায়সারের সঙ্গে দেখা হয় ওর। বাইশতলা উঁচু টেরেসে বসে সন্ধে লাগার মুহূর্তে শহরটাকে আলোকমালায় সেজে উঠতে দেখছিল ও, এইসময় ওর টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াল কায়সার। ‘রানা! দোস্ত, তুই?’ সুদর্শন গ্রীক চেহারায় একাধারে বিস্ময় ও আনন্দের হাসি ফুটছে। কায়সারের চোখ দুটো শুধু উজ্জ্বল নয়, দৃষ্টি এত তীক্ষ্ণ যেন মাথার ভেতরকার সমস্ত গোপন তথ্য জেনে নিচ্ছে। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল, না আঁচড়ালেও সুন্দর একটা আকৃতিতে সাজানো থাকে।
‘হ্যাঁ-রে, শালা, আমি,’ বলে চেয়ার ছাড়ল রানা, বন্ধুকে আলিঙ্গন করল। ‘কিন্তু তুই ব্রাজিলে কি করছিস?’ কায়সারের হাসি নিভে গেল। এই প্রথম খেয়াল করল রানা, বন্ধুর চোখের নিচে কালি জমেছে। শেষবার তাকে কবে দেখেছে স্মরণ করল ও। এই তো মাত্র দু’বছর আগের কথা। প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফ্রন্ট-এর গুরুত্বপূর্ণ একটা দলিল চুরি করে পালাবার পথে এথেন্সে লুকিয়ে ছিল ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের এক এজেন্ট। ইয়াসির আরাফাতের হেডকোয়ার্টার থেকে সেটা উদ্ধার করার অনুরোধ পেয়ে বিপদেই পড়ে যায় রানা এজেন্সি, কারণ ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের চীফ মিস্টার মারভিন লংফেলো রানাকে যেমন সেড়বহ করেন, ও-ও তেমনি ভদ্রলোককে প্রাপ্য শ্রদ্ধা থেকে কখনও বঞ্চিত করে না। তাছাড়া, আনঅফিশিয়ালি রানা ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের একজন অবৈতনিক উপদেষ্টাও বটে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে বিএসএস-এর কোনও এজেন্টকে কাবু করে ডকুমেন্টটা ছিনিয়ে নেয়া রানা এজেন্সির জন্যে বেশ বিব্রতকর। সমস্যাটার কথা তখন কায়সারকে জানায় রানা। পরদিন কায়সার সেই ডকুমেন্টটা ওর হাতে তুলে দেয়। কিভাবে কি করেছে, জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও কিছু বলেনি; শুধু বলেছিল, ‘তোর দেয়া ট্রেনিং কাজে লাগল, এটুকু জেনেই খুশি থাক, দোস্ত।’ এই ট্রেনিঙের ব্যাপারটা ঘটে এই ঘটনার আরও তিন বছর আগে।
সে-সময় বিসিআই চীফ রাহাত খান তাঁর সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় সকল এজেন্টের জন্যে জার্নালিজমে হাতে-কলমে ট্রেনিং নেয়াটাকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। এর পিছনে তাঁর যুক্তি ছিল, একজন স্পাই-এর জন্যে সবচেয়ে আদর্শ কাভার হচ্ছে মিডিয়া রিপোর্টার। যাই হোক, লন্ডনে তিন মাসের একটা কোর্স কমপ্লিট করার পর রানাকে গ্রীসের রাজধানী এথেন্সে পাঠানো হয় সেখানকার ইংরেজি দৈনিক ‘মর্নিং স্টার’-এর সাংবাদিক জুলিয়াস কাইজারের সঙ্গে থেকে হাতে-কলমে কাজ শেখার জন্যে। সেই থেকে দু’জনের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা।
রানা এজেন্সিতে উপযুক্ত লোক নিয়োগ করার জন্য সারা দুনিয়া চষে বাছাই করা হয় কিছু তরুণকে; এদেরকে উত্তীর্ণ হতে হয় নৈতিকতা, আনুগত্য, বিশ্বস্ততা, মেধা, অধ্যবসায় ও নিষ্ঠা সহ আরও অনেক কঠিন সব পরীক্ষায়। এই কাজ সারা বছর ধরে চলতেই থাকে, ফলে বাছাই করা তরুণদের তালিকা যে হারে লম্বা হয় ফ্যাসিলিটির অভাবে সে হারে তাদেরকে ট্রেনিং দেয়া সম্ভব হয় না। জুলিয়াস কাইজার ছিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সেই তরুণদের একজন। জার্নালিজমের ওপর হাতে-কলমে তিন মাস কাজ শেখার পর নিউ ইয়র্কে চলে যায় রানা, সঙ্গে করে নিয়ে যায় জুলিয়াস কাইজারকেও। ওখানে রানা নিজে তাকে একটা শর্ট কোর্স ট্রেনিং কমপ্লিট করায়। তবে দু’জনেই ওরা জানত যে এই শর্ট কোর্স রানা এজেন্সিতে নিয়মিত কাজ করার ছাড়পত্র নয়। তবে মূল ট্রেনিং কোর্স করার জন্যে যখন ডাক পড়বে, এই কোর্সটা তখন খুব কাজে লাগবে কায়সারের, এক বছরের ট্রেনিং তিন মাসে শেষ করতে পারবে সে।
জুলিয়াস কাইজার একজন গ্রীক, তবে সে তার খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয় কারও দ্বারা প্ররোচিত না হয়েই, সেই সঙ্গে নিজের নামও খানিকটা পাল্টে নেয়-জুলিয়াস কাইজার হয় জুলহাস কায়সার।
বন্ধুর হাত ধরে খালি একটা চেয়ারে বসাল রানা, চিৎকার করে ডাকল, ‘ওয়েটার!’ এক চীনা তরুণ ছুটে এল। ডিনারের লম্বা অর্ডার দিল রানা, কায়সার কিছু বলতে যাচ্ছে দেখে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘অনেকদিন পর দেখা, কাজেই সহজে ছাড়া পাচ্ছিস না।’ হাত দুটো এক করে ঘষল বার কয়েক। ‘তারপর বল। কেমন আছিস?’
‘না-রে, দোস্ত, ভাল নেই,’ ম্লান হেসে বলল কায়সার। ‘আমি খুব বিপদের মধ্যে আছি।’
‘কেন? কি ঘটেছে?’ জানতে চাইল রানা।
কাঁধ ঝাঁকাল কায়সার। কিছু বলল না।
‘আমি কোন সাহায্যে আসব?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ব্যাপারটা সিরিয়াস,’ বলল কায়সার। ‘তবে আবার এত সিরিয়াস নয় যে তোর বা আর কারও সাহায্য চাইতে হবে। বিপদটা দেখা দেয়ার পর তোর কথা আমার মনে হয়েছে, কিন্তু যোগাযোগ করার প্রয়োজন বোধ করিনি-কারণ নিজের ওপর বিশ্বাস আছে আমার…’
‘একান্ত ব্যক্তিগত না হলে বিপদটা ঠিক কি রকমের, বল্ না আমাকে।’
‘না, মানে, বলতে আপত্তি নেই,’ ইতস্তত করছে কায়সার।
‘ব্যাপারটা ব্যক্তিগত কিছুও নয়। ঠিক আছে, শোন তাহলে-কেউ একজন আমাকে খুন করতে চাইছে।’
কায়সারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল রানা। ‘ঠিক জানিস? পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে বলছিস কথাটা?’
ক্ষীণ হাসি দেখা গেল কায়সারের মুখে। ‘হানড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত হওয়া কি সম্ভব? এথেন্সে রাইফেলের একটা বুলেট আমার অফিসে জানালার কাঁচ ভাঙল, মাত্র কয়েক ইঞ্চির জন্যে আমার মাথায় লাগেনি-সে কামরায় তখন একাই ছিলাম আমি। পত্রিকার একটা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে তাড়াহুড়ো করে ব্রাজিলিয়ায় চলে আসতে হলো। কিন্তু এখানেও, মাত্র দু’দিন আগে, সিয়েরা আকাপাকু রোডে একটা মার্সিডিজ চাপা দিতে চেষ্টা করল আমাকে। এবারও একটুর জন্যে বেঁচে গেছি। আশ্চর্য কি জানিস, মার্সিডিজের ড্রাইভারকে আগেও দেখেছি আমি -এথেন্সে।’ ‘লোকটার পরিচয় জানিস?’
‘না,’ মাথা নেড়ে বলল কায়সার। ‘তাকে আমি কোলোসস বিল্ডিং থেকে ইদানীং বেরিয়ে আসতে দেখেছি। বিল্ডিংটার ওপর নজর রাখছিলাম…,’ হঠাৎ থেমে রানাকে সে জিজ্ঞেস করল, ‘কোলোসস লাইন্স-এর নাম তো শুনেছিস?’
‘একটা অয়েল ট্যাংকার কোম্পানি।’
‘হ্যাঁ। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ট্যাংকার লাইন। আমার দেশের একজন লোক, মানে একজন গ্রীকই ওটার মালিক। ডাফু সালজুনাস।’
‘আরে, ডাফু সালজুনাসের নাম কে না শুনেছে। বড় মাপের মানুষ। সামান্য নাবিক থেকে বিলিওনেয়ার হয়েছেন। চিরকালই প্রচার বিমুখ। এমন নির্জনতাপ্রিয় ও নিভৃতচারী পুরুষ দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ। খুব কম লোকই নাকি তাঁকে দেখেছে। তবে রানা এজেন্সির হার্ডডিস্কে তাঁর ফটো দেখেছি আমি।’
‘হ্যাঁ।’ মাথা ঝাঁকাল কায়সার। ‘হঠাৎ বছর দশেক আগে পাবলিক লাইফ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন সালজুনাস, তখন তাঁর বয়স ছিল চল্লিশের কাছাকাছি। যাই হোক, কোলোসস বিল্ডিংটা কনস্টিটিউশন প্লাজায়। মনে করা হয় ওই বিল্ডিঙেরই পেন্টহাউসে তাঁর প্রায় সবটুকু সময় কাটে, ব্যবসা-বাণিজ্য যা দেখাশোনা করেন সব ওখান থেকেই। তবে প্রায় কেউই তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে পারে না। যোগাযোগ হয় ঘনিষ্ঠ কর্মচারীদের মাধ্যমে।’
‘খুব বেশি ধনী হবার পর কার কি রকম প্রতিক্রিয়া হবে বলা মুশকিল,’ বলল রানা। ‘কিন্তু ডাফু সালজুনাসের সঙ্গে তোর এই বিপদের কি সম্পর্ক?’
বড় করে শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়ল কায়সার। ‘এই ধর মাস ছয়েক আগে থেকে সালজুনাসের আচরণ বদলাতে শুরু করে। ব্যাপারটা একা শুধু আমাকে নয়, বহু সাংবাদিককেই কৌতূহলী করে তোলে, কারণ পাঠকদের কাছে ডাফু সালজুনাস অত্যন্ত প্রিয় ও উত্তেজক একটা সাবজেক্ট।’
‘আসল কথায় আয়। আচরণ বদলাতে শুরু করে-মানে?’ ‘রাজনীতি সম্পর্কে সালজুনাস কখনোই কোন রকম আগ্রহ দেখাননি,’ বলল কায়সার। ‘কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল এথেন্সের নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে মিডিয়াতে নিয়মিত বিবৃতি পাঠাচ্ছেন তিনি। সে-সব বিবৃতিতে অভিযোগ করা হলো, মন্ত্রীসভার সকল সদস্য, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে আছেন। শুধু তাই নয়, কিছু কর্নেল ও জেনারেলের বিরুদ্ধেও নানান অভিযোগ তুলেছেন তিনি। তাঁর অভিমত হলো-গ্রীসে একটা বিপ্লব দরকার, তা না হলে শান্তি বা সমৃদ্ধি কোনটাই সাধারণ জনগণের কপালে জুটবে না। ভদ্রলোক আভাসে যেন বলতে চাইছেন, গ্রীসে এখন একটা সামরিক অভ্যুত্থান খুবই দরকার।’
‘রাজনীতি সম্পর্কে যে-কেউ আগ্রহী হতে পারে,’ বলল রানা। ‘এর মধ্যে দোষের কিছু নেই।’
‘কিন্তু আমার চোখে দোষ ধরা পড়ল,’ বলল কায়সার। ‘দেখা গেল কর্নেল আর জেনারেলদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিলে কি হবে, সালজুনাসের পেন্টহাউসে অন্য একদল কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার আর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসা-যাওয়া শুরু করেছেন। কিন্তু সালজুনাসের সঙ্গে কি বিষয়ে আলাপ হলো, সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের উত্তর দিতে কেউ তাঁরা রাজি নন। এদিকে রাজধানীতে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ল, ঘুষখোর কিছু সামরিক অফিসারের সাহায্য নিয়ে সালজুনাস একটা প্রাইভেট সেনাবাহিনী গড়ে তুলছেন উত্তর গ্রীসে বিশেষভাবে তৈরি একটা ক্যাম্প, আর মাইকোনোস নামে এক দ্বীপে।
‘তারপর, সমপ্রতি, জেনারেল পয়টারাস নিখোঁজ হয়ে গেলেন। সালজুনাস-এর সমর্থক একটা জাতীয় পত্রিকা রিপোর্ট ছাপল, বোট নিয়ে প্রমোদভ্রমণের সময় লেকে ডুবে মারা গেছেন পয়টারাস। কিন্তু তাঁর লাশ কেউ খুঁজে পেল না। এদিকে সালজুনাস ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন, জেনারেল পয়টারাসের জায়গায় তাঁর পছন্দের লোক জেনারেল হ্যারি কাউরিসকে যাতে পদোনড়বতি দেয়া হয়। অথচ সবাই জানে জেনারেল কাউরিস একজন ফ্যাসিস্ট। সরকার জেনারেল কাউরিসকে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা কমিটিতে চায় না, কিন্তু নির্বাচিত শান্তিপ্রিয় নেতারা সালজুনাসকে ভয় পাচ্ছেন, কারণ সেনাবাহিনীতে তাঁর ভক্ত অফিসাররা সংখ্যায় কম নয়।’ ‘জটিল একটা পরিস্থিতি,’ স্বীকার করল রানা। ‘তবে তোর কি মনে হচ্ছে, ব্যবসা ছেড়ে ক্ষমতার লোভে রক্তাক্ত একটা বিপ্লব ঘটাতে চাইছেন সালজুনাস?’
‘হয়তো। তবে অন্য কিছুর সম্ভাবনাও আছে। আমরা, সাংবাদিকরা, কোলোসস বিল্ডিঙের পেন্টহাউসে নতুন কিছু লোককে আসা-যাওয়া করতে দেখতে পাচ্ছি। ডাফু সালজুনাস অবশ্য এখনও আগের মতই নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। নতুন লোকজনের মধ্যে একজনকে আমি চিনতে পেরেছি, নাম বললে তুই-ও চিনবি। একজন গ্রীক-আমেরিকান, আকার্ডিয়া মারকাস।’ রানার চোখ সামান্য সরু হলো। ‘মারকাস এথেন্সে?’ বিড়বিড় করল। ‘সালজুনাসকে সঙ্গ দিচ্ছে?’
‘দেখে তো তাই মনে হচ্ছে, যদি না…’
‘যদি না কি?’
কাঁধ ঝাঁকাল কায়সার। ‘সালজুনাসের সামপ্রতিক বিদঘুটে কীর্তিকলাপ তাঁর চরিত্রের সঙ্গে একেবারেই মিলছে না, তাই ভাবছি ওগুলোর উৎস হয়তো তিনি নাও হতে পারেন।’
‘সালজুনাস সাম্রাজ্য বেদখল হয়ে গেছে বলতে চাস? নতুন সম্রাটের নাম আকার্ডিয়া মারকাস?’
‘অসম্ভব কি? আমি বলতে চাইছি, হয়তো এরইমধ্যে একটা ছোটখাট ক্যু ঘটে গেছে-চুপিসারে। সালজুনাস যে মাত্রায় গোপনীয়তা পছন্দ করেন আর সমস্ত কাজ লোকজনদের দিয়ে করান, তাঁকে বন্দী বা খুন করে কেউ যদি তাঁর নামে সব কিছু অপারেট করে, সেটা জানাজানি হবার সম্ভাবনা খুবই কম, অন্তত বেশ কিছু দিন। এই সুযোগে তাঁর টাকা সরিয়ে ফেলাও সোজা। ঠিক এই কথাগুলোই আমি আমাদের পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলাম। লেখাটা ছাপা হবার দু’দিন পরই গুলি করা হয় আমাকে।’
দু’জনকেই চুপ করে থাকতে হলো, ওয়েটার টেবিলে ডিনার পরিবেশন করছে। বিরতির এই সময়টা আকার্ডিয়া মারকাসের কথা ভাবছে রানা। তার ফাইল ওর পড়া আছে। অনায়াসেই তাকে রাহু বলা যায়, কারণ পরের ধন গ্রাস করাটাই তার পেশা। কলেজ জীবন কেটেছে ইয়েল-এ, তখন ছিল কমিউনিজম ও সর্বহারাদের পক্ষে, হাতে তৈরি বোমা ফাটিয়ে বুর্জোয়াদের ভয় দেখাত। লেখাপড়া শেষ করে একটা সন্ত্রাসী গ্রুপ গঠন করে সে, গ্রীসের গ্রামে গ্রামে ডাকাতি করে বেড়ায় পাঁচ বছর। ধরা পড়ায় মামলা চলে, হাজত থেকে পালিয়ে দেশ ছেড়ে ব্রাজিলে চলে যায়। যেভাবেই হোক, ব্রাজিলের নাগরিকত্ব পায় মারকাস। প্রথম কয়েক বছর কেউ টেরই পায়নি ব্রাজিলের বড় বড় শহরগুলোয় কি কাজে আসা-যাওয়া করে সে। ধীরে ধীরে আন্ডারগ্রাউন্ডে গুজবটা ছড়াল-আকার্ডিয়া মারকাস চুক্তিতে মানুষ খুন করে। কিছুদিন পরপর পেশার ধরন বদলায় মারকাস। ব্রাজিলে তখন রিয়েল এস্টেট ব্যবসা তুঙ্গে। ব্যবসায়ীরা গুণ্ডা পুষছে অন্যের জমি দখল করার জন্যে। এরকম দু’চারজন ব্যবসায়ীকে খুন করে মারকাস প্রথমে আতঙ্ক সৃষ্টি করল, তারপর দলবল নিয়ে মাঠে নামল ব্যবসায়ীদের জমি জবর দখল করার কাজে। ব্রাজিল পুলিস তাকে ছয়বার গ্রেফতার করলেও প্রমাণের অভাবে প্রতিবার কোর্ট থেকে ছাড়া পেয়ে যায় সে। তবে অনেকেরই সন্দেহ, পুলিস অফিসার, রাজনীতিক, মন্ত্রী ও বিচারকদের কোটি কোটি মার্কিন ডলার ঘুষ দিয়ে নিজেকে মুক্ত রেখেছে মারকাস। সে নাকি তার বন্ধুদের দুঃখ করে বলে, ‘যা কামাই সব তো ঘুষ দিতেই বেরিয়ে যায়, নিজের জন্যে প্রায় কিছুই থাকে না।’
এক এক করে সব রকম অপরাধেই হাত পাকিয়েছে আকার্ডিয়া মারকাস। যুক্তরাষ্ট্রে তার পাঠানো হেরোইনই পরিমাণে সবচেয়ে বেশি। ল্যাটিন আমেরিকার প্রায় সবগুলো দেশে তার একটা নেটওঅর্ক কাজ করছে-কাজটা হলো, বাচ্চা ছেলেমেয়ে ধরে ধনী আরব রাষ্ট্রগুলোয় পাচার করা।
ডিনারটা প্রায় নিঃশব্দেই সারল ওরা। ওয়েটার টেবিল পরিষ্কার করে কফি দিয়ে গেল।
‘আর ওই লোকটা?’ এক সময় জিজ্ঞেস করল রানা। ‘যে তোকে এখানে, ব্রাজিলিয়ায় গাড়ি চাপা দেয়ার চেষ্টা করল? এথেন্সের কোলোসস পেন্টহাউস থেকে তাকে তুই বেরিয়ে আসতে দেখেছিস?’
‘হ্যাঁ, রানা।’ দু’হাতের ভেতর দেশলাই জ্বেলে একটা সিগারেট ধরাল কায়সার। ‘পত্রিকার কাজ শেষ হতে আর মাত্র একদিন বাকি। তারপর ছোট বোন লায়লার সঙ্গে দেখা করতে যাব সান্তা ফিলোমেনায়। ওর কাছে খুব বেশি হলে দিন দুই থাকব, তারপর এথেন্সে ফিরে আকার্ডিয়া মারকাস আর সালজুনাসের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগব আবার…’
‘একা?’ বাধা দিয়ে জানতে চাইল রানা।
‘আপাতত একাই,’ বলল কায়সার। ‘তবে তুই একটা চিঠি লিখে দিবি, প্রয়োজন হলে যাতে রানা এজেন্সির এথেন্স শাখার সাহায্য চাইলেই পেতে পারি।’
‘গুড ডিসিশন,’ মাথা ঝাঁকিয়ে মন্তব্য করল রানা। ‘ওদের সঙ্গে একা তোর লাগতে যাওয়াটা ঠিক হবে না।’
‘সারাক্ষণ তো নিজের কথাই বললাম, এবার বল তোর কি খবর?’ হাসিমুখে জানতে চাইল কায়সার। ‘ব্রাজিলে কি, বেড়াতে?’
‘ছোট্ট একটা অফিশিয়াল কাজে এসেছি, সেটা সেরে ফেলতে আমারও আর একদিন লাগবে,’ বলল রানা। ‘তারপর বেড়াব।’
‘তাহলে চল, আমার বোনের বাড়ি সান্তা ফিলোমেনা থেকে বেড়িয়ে আসবি। তোর কথা ওকে এত বলেছি, তোর রীতিমত ভক্তই বলতে পারিস…’
একটা হাত তুলল রানা। ‘সরি, দোস্ত। ছোট বোনের সঙ্গে পরে কোন এক সময় দেখা করা যাবে। আসলে, রিসর্ট শহর ফোর্টালেজায় আমার জন্যে একজন অপেক্ষা করছে। আমার পৌঁছতে দেরি হলে চলে যাবে সে, এতই অভিমানী…’
ম্লান একটু হেসে কায়সার বলল, ‘সেক্ষেত্রে আমি লায়লার কাছে স্বীকারই করব না যে তোর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। শোন, অফিস থেকে ওরা ছোট্ট একটা প্লেন দিয়েছে আমাকে। আমার সঙ্গে তুই যদি সান্তা ফিলোমেনা পর্যন্ত যাস, পথটা গল্প করে কাটানো যাবে। তোকে তো ওই পথেই ফোর্টালেজা যেতে হবে।’
প্রস্তাবটায় যুক্তি আছে, বন্ধুর অনুরোধ মেনে নিল রানা। ‘ঠিক হ্যায়, তাই যাব।’
দু’দিন পর টু-সিটার সেসনায় চড়ে রওনা হলো ওরা। খবরের পিছনে প্রায়ই প্লেন নিয়ে ছুটতে হয় কায়সারকে, ফলে ইতিমধ্যে পাইলট হিসেবে রীতিমত দক্ষ হয়ে উঠেছে সে। বন-জঙ্গলের ওপর দিয়ে ছোটার সময় প্লেনটাকে যথেষ্ট নিচে রাখল সে, বন্য প্রাণীগুলোকে যাতে দেখা যায়।
সান্তা ফিলোমেনার পথে অর্ধেক দূরত্বও পেরোয়নি সেসনা, কেশে উঠল এঞ্জিন। প্রথমে গুরুত্ব দিল না কায়সার। কিন্তু কাশিটা আরও কর্কশ ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠল। ছোট কন্ট্রোল প্যানেলের এটা-সেটা নাড়াচাড়া করে কোথাও কোন ত্রুটি দেখতে পেল না কায়সার। অথচ পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে প্রতি মুহূর্তে। সেসনার খসে পড়া ঠেকানো যাচ্ছে না। তারপর চক্কর খেতে শুরু করল প্লেন।
হঠাৎ গ্রীক ভাষায় কাকে যেন গালি দিল কায়সার, মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেছে। কন্ট্রোল প্যানেল কোনভাবে স্থির রাখল সে, ঝট্ করে রানার দিকে তাকাল। বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে হেডসেটের ভেতর কপালে। ‘ফুয়েল গজের কাঁটা “ফুল”-এর ঘরে,’ চিৎকার করে বলল রানাকে। ‘সকালে যেখানে ছিল এখনও সেখানেই রয়েছে, এক চুল নড়েনি কাঁটা।’ গজ ঢাকা কাঁচে ঘুসি মারল সে, কিন্তু কিছুই ঘটল না। F অক্ষরের ওপর স্থির হয়ে থাকল কাঁটা।
‘গ্যাস নেই!’ রানার গলায় অবিশ্বাস। যে-কোন প্লেনের জন্যেই এটা দুঃসংবাদ।
‘না, এখনও খানিকটা আছে, তবে এখুনি শেষ হয়ে যাবে,’ বলল কায়সার, আবার কন্ট্রোল প্যানেলের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে সেসনার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার চেষ্টা করছে। ‘স্যাবটাজ করা হয়েছে, রানা। গজের কাঁটা ওই পজিশনে আটকে দেয়া হয়েছে, কিন্তু আমরা রওনা হবার সময় ট্যাংকগুলো প্রায় খালি ছিল। এটা আমার লাইফের ওপর তৃতীয় হামলা। দুঃখ এই যে আমার সঙ্গে তোকেও…’
‘ওহ্, গড!’ ফিসফিস করল রানা। ‘কোথাও ল্যান্ড করানো যায় না?’
মাথা ঝাঁকাল কায়সার। ‘আশপাশে কোন এয়ারফিল্ড নেই, তবে ফাঁকা মাঠ হয়তো পাওয়া যাবে। প্লেনটাকে গ্লাইড প্যাটার্নে রাখতে পারলে ল্যান্ড করাতে পারব।’
‘কে ল্যান্ড করাবে-তুই না আমি?’
‘আমি,’ বলল কায়সার। ‘তুই প্রার্থনা কর। সত্যি আমি খুব দুঃখিত, দোস্ত।’ ভাব দেখে সন্দেহ হলো কেঁদেই না ফেলে।
‘দুঃখিত পরে হোস,’ প্রায় ধমকে উঠল রানা। ‘আগে প্লেনটাকে ল্যান্ড করা।’ প্যারাশুটের কথা জিজ্ঞেসই করল না। জানে নেই; তাছাড়া সময় কোথায়! ফাঁকা একটা জায়গার দিকে গোত্তা খেয়ে নামতে শুরু করেছে সেসনা।