জর্জ বেথুন ইংলিশ
জর্জ বেথুন ইংলিশ (৭ মার্চ ১৭৮৭ – ২০ সেপ্টেম্বর ১৮২৮):
জর্জ বেথুন ইংলিশ একজন আমেরিকান অভিযাত্রী, কূটনীতিক, সৈনিক এবং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি ছিলেন।চার সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড়, ইংলিশ ম্যাসাচুসেটসের কেমব্রিজে জন্মগ্রহণ করেন, যেখানে তিনি ১৭৮৭ সালের ১ এপ্রিল ট্রিনিটি চার্চে বাপ্তিস্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন থমাস ইংলিশ (১৭৫৯-১৮৩৯), যিনি বোস্টনের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, এজেন্ট এবং জাহাজ নির্মাতা ছিলেন, এবং তার মা ছিলেন পেনেলোপ বেথুন (১৭৬৩-১৮১৯), জর্জ বেথুন (১৭২০-১৭৮৫) এবং মেরি ফ্যানেউইল (১৭৩২-১৭৯৭) এর কন্যা, যিনি পিটার ফ্যানেউইলের ভাতিজি ছিলেন।তিনি পরবর্তীতে হার্ভার্ড কলেজে পড়াশোনা করেন, যেখানে তার নিবন্ধ বোডোইন পুরস্কার জিতে। প্রথমে আইন নিয়ে পড়াশোনা করলেও, তিনি ১৮১১ সালে ধর্মতত্ত্বে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। অনেক প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মতত্ত্বের ছাত্রের মতো, তিনি পেন্টাটুক (ইহুদি ধর্মগ্রন্থের প্রথম পাঁচটি বই) অধ্যয়ন করেছিলেন; কিন্তু অন্যদের বিপরীতে তিনি কোরআনও অধ্যয়ন করেন। এই অধ্যয়নের সময়, ইংলিশ খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন এবং তিনি তার সংশয় নিয়ে “দ্য গ্রাউন্ডস অব খ্রিস্টিয়ানিটি এক্সামিনড” নামে একটি বই প্রকাশ করেন, যা তাকে ১৮১৪ সালে খ্রিস্টের চার্চ থেকে বহিষ্কৃত করে এবং অনেক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
ইসলাম গ্রহণ এবং তার পরবর্তী সময়:
জর্জ বেথুন ইংলিশের ইসলাম গ্রহণ এবং তার পরবর্তী জীবন খুবই চিত্তাকর্ষক এবং ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি মিশরে পৌঁছানোর পর ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। সে সময় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন কর্পসে একজন দ্বিতীয় লেফটেন্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন, কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তার সামরিক পদ থেকে ইস্তফা দেন। মুহাম্মদ আলি পাশার অধীনে যোগ দিয়ে তিনি “টোপজি বাশি” বা তোপখানার প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন এবং সেন্নার অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।
ইসলাম গ্রহণের কারণ:
ইংলিশের ইসলাম গ্রহণের পেছনে তার ধর্মীয় অনুসন্ধান এবং সংশয় একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। হার্ভার্ডে ধর্মতত্ত্বের ছাত্র থাকাকালীনই তিনি খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব নিয়ে সংশয় অনুভব করেন, বিশেষত বাইবেলের পেন্টাটুক ও কোরআন অধ্যয়নের সময়। তার ধর্মতত্ত্বের পঠন-পাঠন তাকে নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নিয়ে যায় এবং খ্রিস্টধর্মের প্রতি তার আস্থা কমে যায়। এ ধরনের চিন্তাভাবনাগুলিই তার ইসলাম গ্রহণের পথ সুগম করে।
মুহাম্মদ আলি পাশার অধীনে জীবন:
ইসলাম গ্রহণের পর, ইংলিশ মুহাম্মদ আলি পাশার সেনাবাহিনীতে কাজ শুরু করেন। মুহাম্মদ আলি পাশা মিশরের তখনকার শাসক ছিলেন, এবং তিনি মিশরকে আধুনিকীকরণ এবং সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য কাজ করছিলেন। ইংলিশকে তোপখানার প্রধান নিযুক্ত করা হয়, এবং তিনি নীল নদ বরাবর সেন্নারের দিকে পরিচালিত একটি অভিযানে অংশ নেন, যা ছিল মুহাম্মদ আলি পাশার একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদক্ষেপ। এই অভিযানে তিনি তার সামরিক দক্ষতা এবং নেতৃত্বের গুণাবলির জন্য বিশেষভাবে স্বীকৃতি লাভ করেন।
গোয়েন্দা কার্যক্রমের সম্ভাবনা:
কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন যে জর্জ বেথুন ইংলিশ হয়তো একজন গোপন গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করছিলেন। তার মিশরে থাকা, ইসলাম গ্রহণ, এবং মিশরের শাসকের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার এই সময়কালকে ঘিরে কিছু প্রমাণ রয়েছে যে তিনি হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বা অন্য কোনো রাষ্ট্রের হয়ে গোপন তথ্য সংগ্রহের কাজে জড়িত ছিলেন। তবে এ নিয়ে সরাসরি প্রমাণ সীমিত।
ইসলামিক জীবনে তার অবদান:
জর্জ বেথুন ইংলিশ ইসলামে প্রবেশের পর একটি উল্লেখযোগ্য জীবনযাপন করেন এবং তার ইসলামিক জীবনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল ।ইসলামে প্রবেশের পর ইংলিশ ইসলামের শিক্ষা ও নীতির প্রতি গভীর আগ্রহী হন। তিনি ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য বিস্তারিত অধ্যয়ন করেন এবং ইসলামের নীতি ও আদর্শকে তার জীবনের মূল অংশ করে তোলেন।ইসলাম গ্রহণের পর ইংলিশ মুহাম্মদ আলি পাশার অধীনে একজন সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। তিনি তোপখানার প্রধান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং মিশরের আধুনিকায়নে অবদান রাখেন। তার কাজগুলি কেবল সামরিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং প্রশাসনিক দিক থেকেও প্রভাবশালী ছিল।মিশরে থাকার সময় ইংলিশ স্থানীয় সংস্কৃতি ও সমাজ সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেন এবং ইসলামের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতি একটি গভীর বোঝাপড়া অর্জন করেন। তিনি মুসলিম সমাজের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেন।ইংলিশের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হলো তার “Narrative of the Expedition to Dongola and Sennaar” বইটি প্রকাশ। এই বইটি তার মিশরের অভিযানের অভিজ্ঞতা, ইসলাম গ্রহণের প্রক্রিয়া এবং সেখানে মুসলিম জীবনযাত্রার বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করে। এটি ইসলামের সাংস্কৃতিক ও সামরিক ঐতিহ্য সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র হিসেবে বিবেচিত।ইংলিশ অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে বাণিজ্য চুক্তি সুরক্ষায় কাজ করার সময় ইসলাম সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করেন। তার কাজ ইসলাম এবং মুসলিম জাতির প্রতি একটি আন্তর্জাতিক শ্রদ্ধার অনুভূতি বৃদ্ধি করে।মিশরে থাকাকালীন, ইংলিশ বিভিন্ন মুসলিম চিন্তাবিদ এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং তাদের সঙ্গে চিন্তাভাবনা ও আলোচনা করেন, যা ইসলামের প্রতি তার গভীর বোঝাপড়া বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।জর্জ বেথুন ইংলিশের ইসলামিক জীবনে এই সমস্ত অবদান তার ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে এবং তাকে মুসলিম সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
মৃত্যু:
মুহাম্মদ আলি পাশার জন্য কাজ করার পর, ইংলিশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক বাহিনীতে লেভান্টে কাজ করেন, যেখানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তি সুরক্ষায় কাজ করেন। ১৮২৭ সালে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন এবং ১৮২৮ সালে ওয়াশিংটনে মৃত্যুবরণ করেন।