অসুন্দর বালকের অন্তরে কেবলই আলোড়িত হইত ।
স্কুলে এতবড়ো নির্বোধ এবং অমনোযোগী বালক আর ছিল না । একটা কথা জিজ্ঞাসা করিলে সে হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকিত । মাস্টার যখন মার আরম্ভ করিত তখন ভারক্লান্ত গর্দভের মতো নীরবে সহ্য করিত । ছেলেদের যখন খেলিবার ছুটি হইত তখন জানালার কাছে দাঁড়াইয়া দূরের বাড়িগুলার ছাদ নিরীক্ষণ করিত ; যখন সেই দ্বিপ্রহর-রৌদ্রে কোনো-একটা ছাদে দুটি-একটি ছেলেমেয়ে কিছু-একটা খেলার ছলে ক্ষণেকের জন্য দেখা দিয়া যাইত তখন তাহার চিত্ত অধীর হইয়া উঠিত ।
একদিন অনেক প্রতিজ্ঞা করিয়া অনেক সাহসে মামাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল , “ মামা , মার কাছে কবে যাব । ” মামা বলিয়াছিলেন , “ স্কুলের ছুটি হোক । ”
কার্তিক মাসে পূজার ছুটি , সে এখনো ঢের দেরি ।
একদিন ফটিক তাহার স্কুলের বই হারাইয়া ফেলিল । একে তো সহজেই পড়া তৈরি হয় না , তাহার পর বই হারাইয়া একেবারে নাচার হইয়া পড়িল । মাস্টার প্রতিদিন তাহাকে অত্যন্ত মারধোর অপমান করিতে আরম্ভ করিলেন । স্কুলে তাহার এমন অবস্থা হইল যে , তাহার মামাতো ভাইরা তাহার সহিত সম্বন্ধ স্বীকার করিতে লজ্জা বোধ করিত । ইহার কোনো অপমানে তাহারা অন্যান্য বালকের চেয়েও যেন বলপূর্বক বেশি করিয়া আমোদ প্রকাশ করিত ।
অসহ্য বোধ হওয়াতে একদিন ফটিক তাহার মামির কাছে নিতান্ত অপরাধীর মতো গিয়া কহিল , “ বই হারিয়ে ফেলেছি । ”
মামি অধরের দুই প্রান্তে বিরক্তির রেখা অঙ্কিত করিয়া বলিলেন , “ বেশ করেছ! আমি তোমাকে মাসের মধ্যে পাঁচবার করে বই কিনে দিতে পারি নে । ”
ফটিক আর-কিছু না বলিয়া চলিয়া আসিল — সে যে পরের পয়সা নষ্ট করিতেছে , এই মনে করিয়া তাহার মায়ের উপর অত্যন্ত অভিমান উপস্থিত হইল ; নিজের হীনতা এবং দৈন্য তাহাকে মাটির সহিত মিশাইয়া ফেলিল ।
স্কুল হইতে ফিরিয়া সেই রাত্রে তাহার মাথাব্যথা করিতে লাগিল এবং গা সির্সির্ করিয়া আসিল । বুঝিতে পারিল, তাহার জ্বর আসিতেছে । বুঝিতে পারিল, ব্যামো বাধাইলে তাহার মামির প্রতি অত্যন্ত অনর্থক উপদ্রব করা হইবে । মামি এই ব্যামোটাকে যে কিরূপ একটা অকারণ অনাবশ্যক জ্বালাতনের স্বরূপ দেখিবে তাহা সে স্পষ্ট উপলব্ধি করিতে পারিল । রোগের সময় এই অকর্মণ্য অদ্ভুত নির্বোধ বালক পৃথিবীতে নিজের মা ছাড়া আর-কাহারো কাছে সেবা পাইতে পারে , এরূপ প্রত্যাশা করিতে তাহার লজ্জা বোধ হইতে লাগিল ।
পরদিন প্রাতঃকালে ফটিককে আর দেখা গেল না । চতুর্দিকে প্রতিবেশীদের ঘরে খোঁজ করিয়া তাহার কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না ।
সেদিন আবার রাত্রি হইতে মুষলধারে শ্রাবণের বৃষ্টি পড়িতেছে । সুতরাং তাহার খোঁজ করিতে লোকজনকে অনর্থক অনেক ভিজিতে হইল । অবশেষে কোথাও না পাইয়া বিশ্বম্ভরবাবু পুলিসে খবর দিলেন ।
সমস্ত দিনের পর সন্ধ্যার সময় একটা গাড়ি আসিয়া বিশ্বম্ভরবাবুর বাড়ির সম্মুখে দাঁড়াইল । তখনো ঝুপ্ ঝুপ্ করিয়া অবিশ্রাম বৃষ্টি পড়িতেছে , রাস্তায় এক-হাঁটু জল দাঁড়াইয়া গিয়াছে ।
দুইজন পুলিসের লোক গাড়ি হইতে ফটিককে ধরাধরি করিয়া নামাইয়া বিশ্বম্ভরবাবুর নিকট উপস্থিত করিল । তাহার আপাদমস্তক ভিজা , সর্বাঙ্গে কাদা , মুখ চক্ষু লোহিতবর্ণ , থর্ থর্ করিয়া কাঁপিতেছে । বিশ্বম্ভরবাবু প্রায় কোলে করিয়া তাহাকে অন্তঃপুরে লইয়া গেলেন ।
মামি তাহাকে দেখিয়াই বলিয়া উঠিলেন , “ কেন বাপু , পরের ছেলেকে নিয়ে কেন এ কর্মভোগ । দাও ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও । ”
বাস্তবিক , সমস্তদিন দুশ্চিন্তায় তাঁহার ভালোরূপ আহারাদি হয় নাই এবং নিজের ছেলেদের সহিতও নাহক অনেক খিট্মিট্ করিয়াছেন ।
ফটিক কাঁদিয়া উঠিয়া কহিল , “ আমি মার কাছে যাচ্ছিলুম , আমাকে ফিরিয়ে এনেছে । ”
বালকের জ্বর অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিল । সমস্ত রাত্রি প্রলাপ বকিতে লাগিল । বিশ্বম্ভরবাবু চিকিৎসক লইয়া আসিলেন ।
ফটিক তাহার রক্তবর্ণ চক্ষু একবার উন্মীলিত করিয়া কড়িকাঠের দিকে হতবুদ্ধিভাবে তাকাইয়া কহিল , “ মামা , আমার ছুটি হয়েছে কি । ”
বিশ্বম্ভরবাবু রুমালে চোখ মুছিয়া সস্নেহে ফটিকের শীর্ণ তপ্ত হাতখানি হাতের উপর তুলিয়া লইয়া তাহার কাছে আসিয়া বসিলেন ।
ফটিক আবার বিড়্ বিড়্ করিয়া বকিতে লাগিল; বলিল , “ মা , আমাকে মারিস্ নে মা । সত্যি বলছি , আমি কোনো দোষ করি নি । ”
পরদিন দিনের বেলা কিছুক্ষণের জন্য সচেতন হইয়া ফটিক কাহার প্রত্যাশায় ফ্যাল্ফ্যাল্ করিয়া ঘরের চারি দিকে চাহিল । নিরাশ হইয়া আবার নীরবে দেয়ালের দিকে মুখ করিয়া পাশ ফিরিয়া শুইল ।
বিশ্বম্ভরবাবু তাহার মনের ভাব বুঝিয়া তাহার কানের কাছে মুখ নত করিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন , “ ফটিক , তোর মাকে আনতে পাঠিয়েছি । ”
তাহার পরদিনও কাটিয়া গেল । ডাক্তার চিন্তিত বিমর্ষ মুখে জানাইলেন , অবস্থা বড়োই খারাপ ।
বিশ্বম্ভরবাবু স্তিমিতপ্রদীপে রোগশয্যায় বসিয়া প্রতিমুহূর্তেই ফটিকের মাতার জন্য প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন ।
ফটিক খালাসিদের মতো সুর করিয়া করিয়া বলিতে লাগিল , “ এক বাঁও মেলে না । দো বাঁও মেলে — এ — এ না । ” কলিকাতায় আসিবার সময় কতকটা রাস্তা স্টীমারে আসিতে হইয়াছিল , খালাসিরা কাছি ফেলিয়া সুর করিয়া জল মাপিত ; ফটিক প্রলাপে তাহাদেরই অনুকরণে করুণস্বরে জল মাপিতেছে এবং যে অকূল সমুদ্রে যাত্রা করিতেছে , বালক রশি ফেলিয়া কোথাও তাহার তল পাইতেছে না ।
এমন সময়ে ফটিকের মাতা ঝড়ের মতো ঘরে প্রবেশ করিয়াই উচ্চকলরবে শোক করিতে লাগিলেন । বিশ্বম্ভর বহুকষ্টে তাঁহার শোকোচ্ছ্বাস নিবৃত্ত করিলে , তিনি শয্যার উপর আছাড় খাইয়া পড়িয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিলেন , “ ফটিক! সোনা! মানিক আমার! ”
ফটিক যেন অতি সহজেই তাহার উত্তর দিয়া কহিল , “ অ্যাঁ । ”
মা আবার ডাকিলেন , “ ওরে ফটিক , বাপধন রে! ”
ফটিক আস্তে আস্তে পাশ ফিরিয়া কাহাকেও লক্ষ্য না করিয়া মৃদুস্বরে কহিল , “ মা , এখন আমার ছুটি হয়েছে মা , এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি । ”