বন্ধুরা! কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভাল ও সুস্থ আছো। তোমরা নিশ্চয়ই প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি শব্দ দু’টির সঙ্গে পরিচিত আছে এবং কোনো না কোনো সময় ধোঁকাবাজদের দেখেছো। প্রতারক কিংবা ধোঁকাবাজদের কেউ পছন্দ করে না। ইসলামে কোনো ধোঁকা ও প্রতারণার স্থান নেই। কোনো মুসলমান ধোঁকা দিতে পারে না। ধোঁকা মুনাফেকদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা প্রতারণার জন্য কঠিন শাস্তির কথা বলেছেন।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময় মুনাফেকরা মুখে বলতো আমরা আল্লাহ, রাসূল এবং কুরআনকে মানি কিন্তু তারা বাস্তবে তা মানতো না। তাদেরকে উদ্দেশ করে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : “এমন কিছু লোক আছে যারা বলে আমরা আল্লাহকে এবং শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস করি। প্রকৃতপক্ষে তারা বিশ্বাস করেনি, তারা আল্লাহকে ও মুমিন বান্দাদেরকে ধোঁকা দিতে চায়। (সত্য কথা এই যে) তারা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না। এবং তাদের এই বিষয়ে কোনো উপলব্ধি নেই।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ৮, ৯)
অন্যদিকে নবী করীম (সা. আ.) ধোঁকাবাজ ও প্রতারকদের সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, “ধোঁকাবাজ ও প্রতারকরা জাহান্নামে যাবে। ” ধোঁকা ও প্রতারণা সম্পর্কে ‘প্রতারকের শিক্ষা’ নামে একটি গল্প প্রচার করেছি। গল্পটি নেয়া হয়েছে- প্রায় দু’হাজার বছর আগে প্রাচীন ভারতে লেখা গল্পগ্রন্থ ‘কালিলা ও দিমনা’ থেকে। ‘প্রতারকের শিক্ষা’ বেশ প্রাচীন কালের কথা।
এক ব্যবসায়ী দেশে দেশে ব্যবসা বাণিজ্য করে বেড়াতো। এদেশের মালামাল ওদেশে আবার সেদেশের মালামাল এদেশে এনে বিক্রি করতো। যার ফলে প্রায়ই তাকে সফরে থাকতে হতো। একদিন এরকম এক অজানা দেশে সফরে যাবার আগে ওই ব্যবসায়ী ভাবল পথে যদি তার মালামাল চোর ডাকাত লুট করে নিয়ে যায়- তাহলে তো তাকে খালি হাতে দেশে ফিরতে হবে। তাছাড়া এই সফরে তার কত দীর্ঘ সময় লাগতে পারে জানা ছিল না। তাই ভাবছিল কী করা যায়। পয়সাপাতি যা আছে সেগুলো কোনো বন্ধুর কাছে রেখে গেলে কেমন হয়…কিংবা…..কী করা যায়।
কারো হাতে আস্ত টাকা রেখে যাওয়াটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না…যদি ভেঙ্গে ফেলে কিংবা যদি কোনো বাহানায় ফেরত না দেয়…! এসব নানারকম চিন্তা-ভাবনা করে অবশেষে ব্যবসায়ী ঠিক করল কিছু লোহা কিনবে। লোহা বেশ ভারি হওয়ায় হুট করেই কোনো চোর এসে ঘাড়ে তুলে নিয়ে যেতে পারবে না। লোহা ক্ষয়েও যাবে না, নষ্টও হবে না। আগুনেও পুড়বে না, ভেঙেও যাবে না, পুরনোও হবে না। যখন ফিরে আসবে লোহাটা আবার বিক্রি করে দিলে টাকা হয়ে যাবে।
যেই চিন্তা সেই কাজ। তিনশ’ কেজি লোহা কিনে রেখে গেল তার এক বন্ধুর কাছে। এরপর একদিন পরিবার, প্রতিবেশি ও বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। এরপর প্রায় এক বছর কেটে গেল। সফর শেষে দেশে ফিরে ব্যবসায়ী জানতে পারল লোহার দাম ব্যাপক বেড়ে গেছে। তাই সিদ্ধান্ত নিল বন্ধুর কাছ থেকে লোহাগুলো বুঝে নিয়ে বিক্রি করে দেবে।
কিন্তু বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ঘটল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। ভালো-মন্দ কুশল বিনিময়ের পর বন্ধুর কাছে আমানত রাখা লোহাগুলো ফেরত চাইল ব্যবসায়ী। এসময় পুরনো বন্ধু ব্যবসায়ীকে নিয়ে গেল যে ঘরে লোহাগুলো রেখে গিয়েছিল, সেখানে। এটা ছিল তার নিজের গুদাম। এখানেই লোহাগুলো ছিল কিন্তু এখন নেই। ব্যবসায়ী বলল: এখানে তো কিছুই দেখছি না, লোহাগুলো কোথায়? বন্ধু বলল: কী আর বলব দোস্ত! আমি তো এই গুদাম ঘরেই তোমার লোহাগুলো রেখে তালা দিয়ে রেখেছিলাম, তুমিও তা দেখে গেছ। কিন্তু অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো- তুমি সফরে যাবার কয়েক মাস পর আমি গুদামের দরোজা খুলে দেখতে চাইলাম সব ঠিকমতো আছে কিনা; দরোজা খুলে তো আমি অবাক হয়ে গেলাম।
ব্যবসায়ী জানতে চাইলো: কেন, কী হয়েছিল! বন্ধু বলল: কী আর হবে, দেখলাম ইঁদুরের দল লোহাগুলো সব খেয়ে ফেলেছে। আমি দুঃখিত তোমাকে এই অশুভ সংবাদটি দেয়ার জন্যে। জানি না এখন কী করব! ব্যবসায়ী লোকটি বুঝতে পেরেছে এগুলো সবই বন্ধুর সাজানো নাটক। সাথে সাথে সে চিন্তা করল- নাটকের জবাব নাটক দিয়েই দিতে হবে। বন্ধুর সাথে আর ঝগড়াঝাটি করল না। হাসিমুখে বন্ধুকে বলল: “আরো দোস্ত! তোমার কী দোষ। আমিও শুনেছি ইঁদুরেরা লোহা পেলে খেয়ে ফেলে। ভীষণ ভালোবাসে লোহা। ওরা লোহার স্তুপ পেয়ে দলবল নিয়ে এসে খেয়ে ফেলেছে, তুমি তো আর জানতে না। তালা মারা ছিল, দেখবে কীভাবে। ব্যাপার না। বাদ দাও!”
এই বলে ব্যবসায়ী লোকটি বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালো। ব্যবসায়ী লোকটি হাসিমুখেই তার বিশ্বাসঘাতক বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালো ঠিকই। কিন্তু তার মনের ভেতর যে কী লুকিয়ে ছিল বিশ্বাসঘাতক তা বুঝে উঠতে পারেনি। সেজন্যে ব্যবসায়ীর হাসিমাখা জবাবটি তার কানে তখনো বাজছিল। তার খুবই ভালো লাগলো। মনে মনে বলতে লাগলো- কী আহাম্মক ব্যবসায়ী রে বাবা! আমার বানানো ইঁদুরের গল্প কত সহজেই না বিশ্বাস করে ফেললো! আহাম্মক কোথাকার।
মনে মনে বলল: ব্যবসায়ীকে আজ ভালো করে আপ্যায়ন করালে মন্দ হয় না। মনের ভেতর যদি অবিশ্বাসের লেশমাত্রও অবশিষ্ট থেকে থাকে, তাও কেটে যাবে। এই ফন্দি এঁটে ব্যবসায়ীকে বলল: দোস্ত! এখন যেও না। বস, দুই বন্ধু একসাথে রাতের খাবার খাব আর গল্পগুজব করব। ব্যবসায়ী বলল: দাওয়াতের জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ। জানো তো, মাত্র বিদেশ থেকে এলাম। হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে। আজ নয়। কাল বরং দেখি দুপুরে আসতে পারি কিনা; এই বলে ব্যবসায়ী বেরিয়ে গেল বাসা থেকে।
বাসার বাইরে যেতেই দেখলো বিশ্বাসঘাতক বন্ধুর ছেলেটা খেলা করছে। ব্যবসায়ী ছেলেটাকে আদর করে কোলে তুলে নিয়ে চলে গেল তার বাড়িতে। বাড়িতে গিয়ে বৌকে বলল: ছেলেটাকে কাল রাত পর্যন্ত যত্ন করে রেখো। দেখো বাইরে যেন যেতে না পারে। পরদিন ব্যবসায়ী তার কথামতো বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গেল। গিয়ে দেখে বন্ধুর অবস্থা খুব খারাপ- অস্থির, পেরেশান। ব্যবসায়ীকে দেখেই সে কান্নার স্বরে বলল: আমার ছেলেটা গতকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছি না, হারিয়ে গেছে। সারা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি, কোনো হদিস পেলাম না। আমাকে ক্ষমা কর দোস্ত, বুঝতেই তো পারছো আজ মেহমানদারি করার মতো অবস্থা নেই আমার।
ব্যবসায়ী জিজ্ঞেস করলো: তোমার ছেলে? কালো রঙের জুতা আর সাদা প্যান্ট পরা ছিল? বন্ধু তৎক্ষনাৎ জবাব দিল: হ্যাঁ, হ্যাঁ, কালো জুতা সাদা প্যান্ট… কোথায় দেখেছো? ব্যবসায়ী বলল: কাল তোমার বাসা থেকে বেরুবার সময় দেখলাম একটা কালো কাক আকাশে উড়ে যাচ্ছে। তার পায়ের নখে ঠিক ওইরকম একটা ছেলে ঝুলন্ত ছিল। হতাশ বন্ধু চিৎকার করে বলে উঠল: এই পাগল, আহাম্মক কোথাকার। মশকরা করছো, না? মিথ্যা কথা বলার আর জায়গা পাওনি।
একটা দুই কেজি ওজনের কাক দশ কেজির বেশি ওজনের একটা ছেলেকে পায়ের নখে নিয়ে উড়ে যেতে পারে, না? ফাজিল কোথাকার! ব্যবসায়ী অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় জবাব দিল: আমার তো মনে হয় না অসম্ভব। কারণ যেই শহরে একটা ছোট্ট ইঁদুর তিনশ’ কেজি লোহা খেয়ে ফেলতে পারে, সেই শহরের কাক সামান্য দশ কেজি ওজনের একটা বাচ্চাকে নিয়ে উড়ে যেতে পারবে না কেন?
ব্যবসায়ীর কথা শুনে বিশ্বাসঘাতক বন্ধুর টনক নড়ে উঠল। সে বুঝতে পেরেছে- আসল ঘটনটা কী? ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল এবার ব্যবসায়ীর কাছে। শান্ত হয়ে ব্যবসায়ীকে সে বলল: বুঝতে পেরেছি দোস্ত! সব বুঝতে পেরেছি এখন। আসলে ইঁদুর তোমার লোহাগুলো খায়নি। আমি একটু মজা করলাম আর কি। ওটা আমার বানানো একটা গল্প ছিল। যাও! আমার ছেলেকে নিয়ে আসো, আর তোমার আমানত লোহাগুলো নিয়ে যাও।
প্রতারক বন্ধু উচিত শিক্ষা পেয়েছে দেখে ব্যবসায়ী লোহা ফেরত নিয়ে ছেলেটিকে ফেরত দিল। যাওয়ার বেলার প্রতারক বন্ধুকে ব্যবসায়ী বলল: আমি আমার কাজের জন্য অনুতপ্ত। তোমার ছেলেকে আমার বাড়িতে রেখে তোমাদের কষ্ট দিয়েছি ঠিকই তবে আমার উদ্দেশ্য ছিল আমরা লোহা ফিরে পাওয়া। আমার কাজের চেয়ে তোমার কাজ ছিল অনেক বেশি জঘন্য। কারণ তুমি আমার সঙ্গে খেয়ানত করতে চেয়েছিল, আমার হক মেরে দিতে চেয়েছিল। আর কখনো এ রকম কাজ করো না যাতে অন্যেরাও খারাপ কাজ করতে বাধ্য হয়।