গোরস্তানের প্রহরী রুপে কাবুস
কাবুস ও হামান দুবন্ধু অতঃপর মিসরের রাজধানীর দিকে যাত্রা করল। সেখানে পৌঁছে কাবুস হামানকে বলল, তুমি একটু অপেক্ষা কর। আমি রাজদরবারে গিয়ে দেখি কোন কাজের ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।
মিশরের বাদশাহ তখন দরবারেই ছিল। কাবুস দরবার গৃহে প্রবেশ করে বাদশাহকে যথারীতি অভিবাধন করে বলল, জাঁহাপনা ! আমি এক সহায়-সম্বলহীন নিঃস্ব যুবক। কাজ-কর্ম না থাকায় আমার ভরণ-পোষণে খুবই কষ্ট হচ্ছে। অনুগ্রহ করে আমাকে একটি কাজের ব্যবস্থা করে দিলে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। জীবনে বাঁচতে পারব। কাবুসের বাচনভঙ্গী ও তার জড়তাহীন বাক্য বাদশাহর দৃষ্টি ও মনোযোগ আকৃষ্টি হল। সে কাবুসের বলল, তুমি কি কাজ জান? কাবুস বলল, জাঁহাপনা! আপনি আমাকে রাজকীয় কবরস্থানের প্রহরী নিয়োগ করুন। আমি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করব এবং আশাকরি আমি এ কাজের মাধ্যমে রাজকীয় তহবীলে আশাতীত অর্থ সংগ্রহ করে দিতে পারব। বাদশাহ তার বক্তব্যে সন্তুষ্ট হয়ে শাহী কবরস্থানের প্রহরী নিযুক্ত করলেন।
কাবুস ছোটবেলা হতে যেমনই সুচতুর, তেমনই ছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী। সে কবর স্থানের প্রহরী পদে নিযুক্ত পেয়েই নগরাময় ঘোষনা করে দিল, তখন হতে শাহী কবরস্থানের প্রহরীর মজুরী ছাড়া কেউ কোন লাশ তথায় দাফন করতে পারবে না। দাফনের পূর্বে অনুমতি নিতে হবে। আল্লাহর এমন মহিমা এ বছর নগরে হঠাৎ কলেরা রোগ মহামারীরুপে দেখা দিল। ঘরে ঘরে লোক কলেরায় মৃত্যুবরণ করতে লাগল। ফলে প্রতিদিন সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত শত শত লাশ কবরস্থনে দাফনের উদ্দেশ্যে আনা হত।
কাবুস সদা-সর্বদা কবরস্থনের সদর দরজায়া আসন পেতে বসে থাকত। কখনও কোন কার্যোপলক্ষে কিছু কিছু সময়ের জন্য বাইরে গেলে তার প্রিয়বন্ধু হামানকে নিজের জায়গায় বসাত। হামানও যথাযথভাবে বন্ধু প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করত।
কাবুস মহামারী কারণে লাশ আমদানীর অত্যদিক ভিড় দেখে লাশ দাফনের ফি পূর্বেপেক্ষা কয়েকগুন বেশি করে ফেলন। যার ফলে এ বাবদ অজস্র অর্থ আমদানী হতে লাগল।
কাবুস রাজ কোষে প্রচুর অর্থ জমা দিয়েও নিজে যা রেখে দিত তাতেই সে অগাধ অর্থের মালিক হয়ে গেল। পক্ষান্তরে মিসর হয়ে পদোন্নতি দিয়ে তাঁকে শহর কোতোয়াল নিয়োগ করল। সে শহর কোতোয়াল হওয়ার পর তার আর্থিক অবস্থা আরও উন্নতি হল। সে মনে মনে আরও উচ্চাকাঙ্খা পোষন করছিল। ফলে বাদশাহ কে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্য মাঝে মাঝে বহু টাকা খরচ করে বিভিন্ন জিনিসপত্র ক্রয় করে বাদশাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে যেত এবং তাঁকে তা উপহার-উপঢৌকনস্বরূপ প্রদান করত। এ জাতীয় কৌশলসুলভ আচরণ দ্বারা সে প্রাধান উজীরের সাথেও সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।
কোতোয়াল পদে উদ্দোন্নতি লাভের কিছু দিন পর মিসরের প্রধান উজীর হঠাৎ রোগাক্রান্ত হয়ে মাত্র দু একদিন রোগ ভোগ করেই মৃত্যুবরণ করল। বাদশাহ পূর্ব থেকেই শহর কতোয়াল কাবুসের যোগ্যতার প্রতি আস্থাশীল হয়ে উঠেছিল। তার অন্যান্য উজীরের চেয়ে তাকেই অধিক যোগ্য ও বিচক্ষণ বলে মনে করত। যার ফলে সে কোন উজীরকে প্রধান উজীরের পদে নিয়োগ না দিয়ে শহর কোতোয়াল কাবুসকেই এ পদে নিয়োগ দিল। এতে অন্যান্য উজীররা অবশ্য বাদশাহর প্রতি অসুন্তুষ্ট হল, কিন্তু তাতে কি আসে যায়? কাবুসের প্রধান উজীর হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন যোগ্যতা প্রদর্শন করতে লাগল যে, তাতে সকলে কাবুসের যোগ্যতা ও বিচক্ষণতার প্রশংসা করতে লাগল।
প্রধান মন্ত্রীর পদলাভের পর তার লোভের মাত্রা সীমাতিক্রম করল। সে শুধু রাজত্ব লাভের জন্য লালায়িত হলে হত। কিন্তু না, রাজাধিরাজ হওয়ার তীব্র বাসনা তাঁকে তাড়া করতে লাগল। সে কেবল অন্য সকল বাদশার মত কাল কাটাতে চায় না। সে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ট বাদশাহ হতে চাই। সে চায় দেশের জনসাধারণ তার উপাসনা করুক।
একদা কাবুস তার প্রিয়বন্ধ হামানের কাছে তার মনের এ বাসনার কথা প্রকাশ করল। হামান ধূর্ততা ও বিচক্ষণতায় কাবুস অপেক্ষাও একধাপ উপরে ছিল। সে কাবুসকে বলল, বন্ধু! তুমি সুযোগ্য পাত্র। তোমার সব বাসনাই তুমি পূণ্য করতে পারবে। এজন্য তোমাকে খুব ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হবে। বেশি তাড়হুড়ার ফল ভাল হয় না। এ কথা বলে হামান কাবুসকে একটু সুক্ষ্ম পরামর্শ দিল। কাবুস হামানের পরামর্শনুযায়ী একদিন বাদশাহকে বলল, জাঁহাপনা! বর্তমানে আমাদের দেশে অজন্মা ও নানারুপ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে প্রজা সাধারণ অভ্যন্ত দূরাবস্থার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে। তাই আমাদের উচিত, তাহাদের অন্ততঃ দুইটি বৎসরের খাজনা মাফ করে দেয়া। বাদশাহ বলল, তা হয় না উজীর! কেননা দু বছরের খাজনা বাবত যা অর্থ অর্জিত হয় তা বন্ধ হলে সরকারী তহবিলে যে দূর্বলতা দেখা দিবে তা কাটিয়ে উঠা কোন প্রকারেই সম্ভব নয়। তবে শুধু তোমার পদমর্যাদার সম্মানে আমি প্রজা সাধরনের এক বছেরের খাজনা মাফ করে দিলাম। কাবুল বলল, জাহাঁপনা! সরকারী তহবীলে ঘাট্টি নেমে আসুক তা আমার কাম্য নয়। তবে আমি তা কেবল প্রজাসাধরণের দূরবস্থা ও অপারগতার প্রতি লক্ষ্য করে এ প্রস্তাব দিয়েছে। বাদশাহ বলল, উজীর! আমি অসুবিধার কথাও তোমাকে বললাম, এখন তুমি যা ভাল বিবেচনা কর, বুঝে-শুনে তাই কর।
অতঃপর কাবুস বাদশাহর কাছে থেকে উঠে এসে তখনই এসে সমগ্রদেশে এ মর্মে একটি সরকারী ঘোষনা প্রচার করার ব্যবস্থা করল যে, দেশের সর্বসাধারণের উপস্থিত আর্থিক দূরবস্থার প্রতি লক্ষ্য করে সম্রাট বাদাদুর প্রজাসাধারণের এক বছরের খাজনা মাফ করে দিলেন। আর তাঁদের আর এক বছরের খাজনা স্বয়ং উজীরের আজম প্রজাসাধরণের পক্ষ্য স্বীয় ব্যক্তিগত তহবিল হতে রাজ কোষে জমা করে দিবেন; সুতরাং দেশের প্রজারা দু বছরের খাজনা প্রদান হতে মুক্তি লাভ করল।
এই আশ্চর্য ঘটনায় দেশের সমগ্র প্রজাদাধারণের উজীরে আজম মাবুসের প্রতি ধন্য করে উঠল এবং শত মুখে তার প্রশংসা করতে লাগল। পক্ষান্তরে বাদশাহও তার প্রতি অত্যাধিক খুশি হল এবং তার উদার মনের পরিচয় পেয়ে তার প্রতি বিবেষভাবে আকৃষ্ট হল।
এদিকে বাদশাহ ও খুবই বৃদ্ধ হয়ে গেছ একদা বার্ধক্যজনিত কারণে সে মৃত্যুমুখে পতিত হল। এভাবে সিংহাসন শূন্য হয়ে গেল। সাথে সাথে সিংহাসনের যোগ্য উত্তরাধিকারী নিয়োগের প্রয়োজনীতা দেখা দিল। মৃত রাজার কোন উত্তরাধিকারী না থাকায় রাজকীয় কর্মকর্তাবৃন্দ এ বিষয়ে সুরাহা করার জন্য দেশের সরদার এবং নেতৃস্থনীয় ব্যক্তিদেরকে রাজ দরবারে আহ্বান জানাল।
যথা সময়ে আগত নেতৃবৃন্দসহ এক পরামর্শ সভা বসল। সভায় সমবেত সদস্যদের প্রায় সকলেই উজীরের আজমকেই বাদশাহর পদে বরণ করার জন্য মত প্রকাশ করল। সুতরাং উক্ত সভায় সকলের সম্মুখেই উজীরে আজম কাবুসের মস্তকে শাহীমুকুট পরিয়ে দেয়া হল।
একেই বলে ভাগ্য! একটি সহায়-সম্বলহীন ভবঘুরে যুবক কবরস্থানের পাহারাদারের চাকুরী হতে আরম্ভ করে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে রাজদরবারের সর্বোচ্চপদ অতিক্রম করে এখন দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বাদশাহর আসনে অধিষ্ঠত হল। কাবুস বাদশাহর আসনে উপবিষ্ট হয়ে সর্বপ্রথম সে তার বন্ধু হামানকে প্রধান উজীরের পদে নিযুক্ত করল। অতঃপর সে মিসরের পূর্ব প্রজাহিতৈষী প্রবল পরাক্রান্ত শাসক রামসীস এর নাম গ্রহণ করত। নিজেকে দ্বিতীয় রামসীস নামে প্রচার করল। তাছাড়া মিসরের প্রচলিত রীতি অনুসারে সে ফেরআউন উপাধিও ধারণ করল।