গল্পের ৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
তারপর সেই বন্ধু বদলে গেল যখন ছাত্রজীবন শেষ করে মোহিত চাকরির জীবনে প্রবেশ করলেন। এখন তিনি তাঁর আপিসের চারজন মাথার মধ্যে একজন; এবং তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলো তাঁরই একজন সহকর্মী। স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে একমাত্র প্রজ্ঞান সেনগুপ্তের সঙ্গে মাঝে মাঝে ক্লাবে দেখা হয়; সেও ভালো আপিসে বড় কাজ করে। আশ্চর্য, ইস্কুলের স্মৃতির মধ্যে কিন্তু প্রজ্ঞানের কোনো স্থান নেই। অথচ জয়দেব—যার সঙ্গে ত্রিশ বছর দেখাই হয়নি—স্মৃতির অনেকটা জায়গা দখল করে আছে। এই সত্যটা মোহিত পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে বেশ ভালো করে বুঝতে পারলেন।
মোহিতের অফিসটা সেন্ট্রাল এভিনিউতে। চৌরঙ্গী আর সুরেন ব্যানার্জির সংযোগস্থলের কাছাকাছি আসতেই গাড়ির ভিড়, মোটরের হর্ন আর বাসের ধোঁয়া মোহিত সরকারকে স্মৃতির জগৎ থেকে হুড়মুড়িয়ে বাস্তব জগতে এনে ফেলল।
হাতের ঘড়িটার দিকে চোখ পড়াতে মোহিত বুঝলেন যে তিনি আজ মিনিট তিনেক লেট হবেন।
অফিসের কাজ সেরে সন্ধ্যায় তাঁর লি রোডের বাড়িতে যখন ফিরলেন মোহিত, তখন তাঁর মনে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের স্মৃতির কণামাত্র অবশিষ্ট নেই।
সত্যি বলতে কী, তিনি সকালের টেলিফোনের কথাটাও বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন; সেটা মনে পড়ল যখন বেয়ারা বিপিন বৈঠকখানায় এসে তাঁর হাতে রুলটানা খাতার পাতা ভাঁজ করে ছেঁড়া একটা চিরকুট দিল। তাতে ইংরেজিতে লেখা—’জয়দেব বোস, অ্যাজ পার অ্যাপয়েন্টমেন্ট’।
রেডিওতে বিবিসির খবরটা বন্ধ করে মোহিত বিপিনকে বললেন, ‘ভেতরে আসতে বল’—আর বলেই মনে হলো, জয় এতকাল পরে আসছে, তার জন্য কিছু খাবার আনিয়ে রাখা উচিত ছিল।
আপিস-ফেরতা পার্ক স্ট্রিট থেকে কেক-পেস্ট্রিজাতীয় কিছু কিনে আনা তাঁর পক্ষে খুবই সহজ ছিল, কিন্তু খেয়াল হয়নি। তাঁর স্ত্রী কি আর নিজে খেয়াল করে এ কাজটা করেছেন?
‘চিনতে পারছ?’
গলার স্বর শুনে, আর সেই সঙ্গে কণ্ঠস্বরের অধিকারীর দিকে চেয়ে মোহিত সরকারের যে প্রতিক্রিয়াটা হলো সেটা সিঁড়ি উঠতে গিয়ে শেষ ধাপ পেরোনোর পরেও আরেক ধাপ আছে মনে করে পা ফেললে হয়।
চৌকাঠ পেরিয়ে যিনি ঘরের ভেতর এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর পরনে ছাই রঙের বেখাপ্পা ঢলঢলে সুতির প্যান্টের ওপর হাতকাটা সস্তা ছিটের শার্ট দুটির কোনোটিও কস্মিনকালে ইস্তিরির সংস্পর্শে এসেছে বলে মনে হয় না।
শার্টের কলারের ভিতর দিয়ে যে মুখটি বেরিয়ে আছে তার সঙ্গে অনেক চেষ্টা করেও মোহিত তাঁর স্মৃতির জয়দেবের সঙ্গে কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পেলেন না।
আগন্তুকের চোখ কোটরে বসা, গায়ের রঙ রোদে পুড়ে ঝামা, গাল তোবড়ানো, থুতনিতে অন্তত তিন দিনের কাঁচা-পাকা দাড়ি, মাথার উপরাংশ মসৃণ, কানের পাশে কয়েক গাছা অবিন্যস্ত পাকা চুল।
প্রশ্নটা হাসিমুখে করায় ভদ্রলোকের দাঁতের পাটিও দেখতে পেরেছেন মোহিত সরকার, এবং মনে হয়েছে পান-খাওয়া ক্ষয়ে-যাওয়া অমন দাঁত নিয়ে হাসতে হলে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাসা উচিত।
‘অনেক বদলে গেছি, না?’
‘বোসো।’