কান্তার মরু – ১৪ –মাসুদ রানা– শেষ পর্ব !

ম্যাকলিনের তাড়া খেয়ে যে বারটিতে গিয়ে ঢুকল ওরা, সেটিও বড় সুবিধের জায়গা নয়। পছন্দসই পতিতাদের এখান থেকে বেছে নিয়ে যায় খদ্দেররা। দেখা গেল, সন্ধের ঠাণ্ডা বাতাসের তোয়াক্কা নেই মেয়েগুলোর। দিব্যি পাতলা সামার ড্রেস পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময়, আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করছে ওরা নিজেদের। রানারা বারে ঢুকতে কটমট করে জুলেখাকে মাপল ওদের চোখ। এমনকি যাদের সঙ্গে খদ্দের রয়েছে তাদের চাহনিও বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হলো না। দুটো কারণে এদের রাগ হয়ে থাকতে পারে জুলেখার প্রতি। প্রহম, জুলেখা আমহারিক, এই মেয়েগুলো হয়তো ভিনড়ব গোত্রের। এবং দ্বিতীয়ত, ওরা হয়তো ভেবেছে খদ্দের কেড়ে নিতে এসেছে নতুন আপদ। যা হোক, জ্যাকেটের চেন খুলে দিল রানা। শোল্ডার হোলস্টারে লুগারটাকে ঘুমোতে দেখলে সম্ভবত আগুনে পানি
পড়বে ওদের।
পরিস্থিতি বিচার করতে ভুল হয়নি জুলেখারও। ‘রানা,’ অনুচ্চ স্বরে বলল। ‘পিঠের দিকে খেয়াল রেখো। ফাইট করতে হতে পারে।’
‘হুঁ,’ বলল রানা। ‘ফোনটা ইউজ করতে পারি?’ বারে ঠেস দিয়ে বার্টেন্ডারকে জিজ্ঞেস করল।
‘দু’ব−ক পরে ডানদিকে একটা পে ফোন আছে!’
জ্যাকেটটা আরেকটু খোলসা করল রানা। ‘অত হাঁটতে যাবে কে?’ জবাব চাইল।
স্থানীয় ভাষায় কড়া গলায় কি যেন বলল জুলেখা। যাই বলুক না কেন, বারের দুটো টুল পেছনে বসে থাকা লোকটার তা পছন্দ হলো না। প্যান্টের পকেট থেকে সাঁত করে এক সুইসব্লেড বের করে আনল সে। লুগারটা টেনে নিয়ে লোকটার মুখের ওপর ব্যারেল দিয়ে সজোরে টোকা দিল রানা। মেঝেয় ঢলে পড়ে গোঙাতে লাগল লোকটা, ঠোঁট কেটে রক্ত বেরোচ্ছে।
‘ফোন,’ বার্টেন্ডারকে স্মরণ করাল রানা।
‘নেই।’
রানা এক লাফে বার টপকে গিয়ে পড়তে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল লোকটা। ড্রাফট বীয়ার ট্যাপের পেছন থেকে পিস্তলটা যে বের করবে সে ফুরসতও পেল না ও। রানা বাঁ হাতে ওর ডান হাত মুচড়ে ফোনের অবস্থান জেনে নিল। এবার ঘরের পেছনদিকে নিয়ে চলল লোকটাকে।
‘বোকামি কোরো না,’ শাসাল। ‘পিস্তল বের করার চেষ্টা করেছ কি মরেছ।’
বারের পেছনে ছুটে এল জুলেখা। স্কার্ট উঠে যেতে ঝিলিক দিল ওর লম্বা পা দুটো। বার্টেন্ডারের পিস্তলটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে, তাক করে ধরল ও পতিতা আর খদ্দেরদের উদ্দেশে। ওর কঠোর অথচ সংক্ষিপ্ত আঞ্চলিক ভাষার ভাষণটা রানাকে অনুবাদ করে শোনানোর প্রয়োজন পড়ল না। সারমর্ম বুঝে নিল রানা: জায়গা ছেড়ে নোড়ো না, আরামে ড্রিঙ্ক করো, এবং রাতে যা খুশি করতে পারো।
বার্টেন্ডার ফোনের কাছে নিয়ে এল ওদের। রানা কভার করল ওকে এবং জুলেখা জেনারেল হাশমীর সঙ্গে কথা বলল। কি কি ঘটেছে, ওরা এখন কোথায় এসব জানাল। এবার বার্টেন্ডারকে ফোনটা দিল ও। জেনারেল কি বললেন লোকটিকে কে জানে, কিন্তু দেখা গেল, রানা আর জুলেখার বীরত্ব দেখেও যা পায়নি, তারচাইতে বেশি ভয় পেয়ে গেছে বেচারা। ওরা যতক্ষণ অপেক্ষা করল কোন খদ্দের বারের কাছ ঘেঁষল না। পনেরো মিনিট বাদে দুজন ষণ্ডা মার্কা দীর্ঘদেহী সৈনিককে নিয়ে বারে প্রবেশ করলেন জেনারেল। তাঁকে দেখে মেঝেতে মিশে যায় আরকি বার্টেন্ডার।
‘গুড ইভনিং, মিস্টার রানা,’ বললেন জেনারেল। ‘জুলেখা সবই বলেছে। দেখা যাচ্ছে ম্যাকলিনের ব্যাপারে ভুল বলেনি আমার লোক।’
‘আমি আগেই জানতাম,’ বলল রানা। ‘আপনার আন্ডারে সবাই দক্ষ লোক।’
মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল জেনারেলের।

আসমারার উপকণ্ঠে এক আর্মি বেস। জেনারেল হাশমীর প্রাইভেট কোয়ার্টার। রানা ও জুলেখাকে নিয়ে এসে প্রচুর আদর-আপ্যায়ন করেছেন জেনারেল। ফোনে কথা বলেছেন নানা জায়গায়। তারপর রাত তিনটের দিকে আলোচনায় বসলেন ওদের সঙ্গে।
‘আচ্ছা, শেপ মাইয়ারে মালদিনি ছিল বলে এখনও বিশ্বাস করেন আপনি?’ প্রশ্ন করলেন রানাকে।
শ্রাগ করল রানা। ‘জাস্ট আন্দাজ করতে পারি। প্রশ্ন হচ্ছে, ম্যাকলিন কি নিজে থেকেই এসব করল? আমার ধারণা, তা নয়। ও আর মালদিনি ওই জাহাজে ওঠেনি।’
‘তাহলে গেল কোথায় লোকটা?’
‘আছে ইথিওপিয়াতেই কোথাও,’ বলল রানা।
‘ম্যাকলিন জ্ঞান ফিরে পাওয়ার আগেই মারা গেছে অপারেশন রূমে। মালদিনির খোঁজ জানার আরেকটা সুযোগ ফস্কে গেল।’
‘কিন্তু ওই মিসাইলগুলোর ব্যাপারে তো একটা কিছু করতে হবে আপনাকে, জেনারেল,’ বলল রানা। ‘তা নাহলে আপনার দেশ অনেকের কোপানলে পড়বে।’
‘না, মিস্টার রানা, সেই কিছুটা করছেন আপনি। সম্প্রতি কিছু কিছু ব্যাপারে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। আমরা আপনাকে মিসাইলগুলো নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেব। বাংলাদেশ
ইথিওপিয়ার কোস্টে একটা ক্যারিয়ার রাখবে। হেলিকপ্টার টেকনিশিয়ানদের এখানে পৌঁছে দেবে। মিসাইল থাকবে মরুভূমিতে, কিন্তু নিউক্লিয়ার ওঅরহেডগুলো জাতিসংঘের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে বাংলাদেশকে দিয়ে দেয়া হবে। আপনি আমাদের জন্যে এত করলেন, আপনার দেশের মাধ্যমেই ওগুলো জাতিসংঘের হাতে পৌঁছাক আমরাও তাই চাই। মিসাইল বানানো তেমন কষ্টসাধ্য কাজ নয় জানেনই তো, নিউক্লিয়ার ওঅরহেড আসলে ডেঞ্জারাস করে তোলে ওগুলোকে।’
‘যারা ওগুলো পাহারা দিচ্ছে তাদের ওপর কন্ট্রোল আছে আপনার?’
‘হ্যাঁ,’ বললেন জেনারেল। ‘গভীর মরুভূমিতে পাঠানো হয়েছে ওদের। বুদ্ধিটা কেমন, দারুণ না?’
দ্বিমত করতে পারল না রানা।
‘দু’একদিনের মধ্যেই ফাইনাল ডিটেইলস পেয়ে যাবেন। সে কদিন ইথিওপিয়ার আতিথ্য গ্রহণ করুন, মিস্টার রানা।’
জেনারেল হাশমীর ড্রাইভার একটু পরে জীপে তুলে, রানা আর জুলেখাকে যার যার বাসায় পৌঁছে দিল।

পাঁচদিন বাদে প্রতিটি খুঁটিনাটি বিবরণ হাতে পেল রানা। জেনারেল হাশমী জানিয়েছেন ওকে, সকাল ছটায় স্বয়ং উপস্থিত থেকে আসমারার সীমানা পার করে দেবেন। মাসুদ রানা আর আসমারায় ফিরছে না। ডানাকিল থেকে সোজা গিয়ে বাংলাদেশী ক্যারিয়ারে
উঠবে ঠিক করে দেয়া হয়েছে ঢাকা থেকে। কাজেই জুলেখার কাছ থেকে আবেগঘন বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে রানা। এ ক’দিনে বেশ একটা ভাই-বোনের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল ওদের মধ্যে। ওকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কেঁদেছে মেয়েটি।
‘তোমাকে আমি কোনদিন ভুলতে পারব না, রানা,’ কাঁদতে কাঁদতে বলেছে। ‘তুমি আমার জন্যে যা করেছ মুখে বলে তোমাকে ছোট করতে চাই না। আমাকে মরণের হাত থেকে, অসম্মানের হাত থেকে বাঁচিয়েছ।’
‘ছিঃ, বোকা মেয়ে,’ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছে রানা। ‘আমি কিছুই করিনি। যেটুকু করেছি মানুষ মানুষের জন্যে তারচাইতে অনেক বেশি করে।’ চোখের পানি মুছে দিয়েছে ও জুলেখার।
‘আবার কবে আসবে? কথা দাও, আমাকে ভুলে যাবে না।’
‘তোমাকে কি ভোলা যায়? তাছাড়া, আমি তো সুযোগ পেলেই আবার চলে আসব।’ ওর কপালে চুমু দিয়ে বলেছে রানা। মনে মনে করুণ হেসেছে। আজ এ দেশে তো কাল সে দেশে শত্রুর পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে ও, মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় করে। কবে, কখন সুযোগ হবে আবার এদেশে আসার আল্লাই জানে। হয়তো আদৌ কোনদিন হবেই না।

সুটকেস গোছায়নি রানা। লুগার আর স্টিলেটো ছাড়া অন্য কোন মালামালের প্রয়োজনও নেই ওর। মালদিনির চ্যালারা কেউ ওর ওপর নজর রেখে থাকলে বুঝতে পারবে না দক্ষিণযাত্রা করতে চলেছে রানা। উন্মাদ লোকটাকে শায়েস্তা করে, নিউক্লিয়ার ওঅরহেডগুলো ইথিওপিয়া থেকে সরিয়ে নেয়াই এখন ওর মূল কাজ। ও নিশ্চিত ভাবেই জানে বেঁচে আছে মালদিনি। সুযোগের অপেক্ষায় আছে।
গাড়ি নিয়ে এলেন জেনারেল। ‘সারাদিন লেগে যাবে,’ বললেন। চমৎকার ড্রাইভ করেন ভদ্রলোক, নানা জীব-জন্তু আর মান্ধাতা আমলের গাড়িগুলোকে দক্ষ হাতে পাশ কাটিয়ে
দক্ষিণমুখো চালাচ্ছেন গাড়ি। স্থানীয় রেল রোডের চাইতে ইথিওপিয়ার সড়ক যোগাযোগ ভাল হলেও পে−ন ভ্রমণই রানার কাছে সেরা মনে হলো। ভদ্রলোক কেন গাড়ি ড্রাইভ করা বেছে নিলেন ব্যাখ্যা করলেন না। রানাও এ ব্যাপারে কিছু জানতে চাইল না।
যাত্রার বেশিরভাগটা সময় স্যান্ডহার্স্টে তাঁর ছাত্র জীবন সম্পর্কে বকে গেলেন জেনারেল। তাঁর কণ্ঠে ব্রিটিশদের প্রতি যুগপৎ প্রশংসা ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটল। হুঁ-হা করে তাল
মিলিয়ে গেল রানা তাঁর সঙ্গে।
জেনারেলের এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাতটা কাটাল ওরা। বাড়ির কোন মহিলাকে চোখে পড়ল না রানার। গৃহকর্তার সঙ্গে কেবল সংক্ষিপ্ত আলাপ হলো ওর খাওয়ার সময়।
সূর্যোদয়ের ঘণ্টা খানেক আগে, ছোট্ট এক এয়ারফিল্ডে, গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এলেন জেনারেল রানাকে।
‘পাইলটকে বিশ্বাস করতে পারেন,’ বললেন তিনি। ‘রেডিও ব্যবহার করে আপনার লোকেদের কল করুন।’
হেলিকপ্টারের পেছনে কমিউনিকেশন্স স্টেশনে এল রানা, যোগাযোগ করল ক্যারিয়ারের সঙ্গে। ওদিকে গা গরম করছে কপ্টারের এঞ্জিন।
‘তছনছ করে দেয়া হয়েছে মালদিনির পপি খেত। একটা গ্রীনহাউজও আস্ত নেই। মরুভূমির গভীরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মিসাইলগুলো,’ বললেন জেনারেল হাশমী। ‘কেউ ওগুলো পাহারা দিচ্ছে না। আপনার লোকেরা এসে পড়লেই চলে যাব আমি। ঠিক আছে, মিস্টার রানা?’
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল মাসুদ রানা।
বাংলাদেশী টাস্ক ফোর্স ইতোমধ্যে শূন্যে উড়াল দিয়েছে, পনেরোটা নেভি হেলিকপ্টার প্রবেশ করেছে ইথিওপিয়ার আকাশ সীমায়।
এই দেশে যেরকম গোত্র দ্বন্দ্ব, ভাবল রানা, তাতে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই নিউক্লিয়ার ওয়রহেড নিয়ে ফেরার পথে বাধা পড়বে না। কোন গ্রুপ যদি চায় ওগুলো ইথিওপিয়াতে থাকুক, জাতিসংঘের হাতে না যাক, তাহলে? আর কি, গন্ডগোল, রক্তপাত।
পুবে যাওয়ার পথে তিনটে উটের কাফেলার ওপর দিয়ে উড়ে গেল কপ্টার। ডানাকিল মরুভূমির কষ্টের স্মৃতি মনে পড়ে গেল রানার জানোয়ারগুলোকে দেখে। ইথিওপিয়ানরা কি মালদিনির ডানাকিল সমর্থকদের বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশন নিয়েছে? জেনারেল হাশমীকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও চেপে গেল রানা।
ভদ্রলোক হয়তো ভাবতে পারেন তাঁদের ঘরোয়া রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছে রানা।
উচ্চতা হারাতে শুরু করেছে ওরা। নিচে চাইতে, নিখুঁত সারিতে রাখা মিসাইলগুলোয় সূর্যকিরণ ঝিকাতে দেখল রানা। মালদিনির হেডকোয়ার্টার থেকে এই বেলে অঞ্চলে ওগুলোকে টেনে এনেছে বেশ কয়েকটা বড় বড় ট্রাক্টর। সেগুলো অবশ্য এখন নেই। সম্ভবত এয়ারলিফট করা হয়েছে যন্ত্রগুলোকে, কেননা ট্র্যাক দেখা গেল একমুখী।
‘আপনাদের টাস্ক ফোর্স আসতে কতক্ষণ বাকি, মিস্টার রানা?’ প্রশ্ন করলেন জেনারেল হাশমী।
‘বিশ মিনিট,’ বলল রানা।
পাইলটের উদ্দেশে আদেশ বর্ষালেন তিনি। মিসাইলের ঠিক পশ্চিমে, শূন্যে খানিকক্ষণ ভেসে থেকে, তারপর নামতে শুরু করল কপ্টার।
‘ফুয়েল পোড়ানোর কোন অর্থ নেই,’ বললেন জেনারেল। পুড়িয়ে দেয়া পপি খেতের মাটি স্পর্শ করল কপ্টার। র‍্যাক থেকে রাইফেল তুলে নিয়ে রানাকেও একটা নিতে ইঙ্গিত করলেন জেনারেল। রানা দেখে নিল তার রাইফেলের ম্যাগাজিন ভর্তি আছে কিনা।
‘আসুন,’ বলে কপ্টারের ডানদিকের দরজা দিয়ে লাফিয়ে নামলেন ভদ্রলোক।
রানা অনুসরণ করতে যাবে এমনিসময় গর্জে উঠল অটোমেটিক অস্ত্র। একাধিক। সাঁত করে রানা মাথা নামিয়ে পিছু হটতে এক ঝাঁক বুলেট কপ্টারের একটা পাশ চালুনি করে দিল। জেনারেল হাশমী টলে উঠে কপ্টারের মেঝের কিনারা খামচে ধরলেন। হাত বাড়িয়ে নিচ থেকে তাঁকে টেনে তুলল রানা খোলা দরজাটা দিয়ে।
রোটর চালু হতে কাঁপুনি উঠল কপ্টারে। আরও এক পশলা বুলেট আঘাত হানল। খোলা দরজা গলে একটা বুলেট কপ্টারে ঢুকতেই মুখে বাতাসের ঝাপটা অনুভব করল রানা।
‘জলদি উঠুন!’ চেঁচাল রানা, ইশারা করল পাইলটের উদ্দেশে।
বৃদ্ধি পেল এঞ্জিনের পাক খাওয়ার গতি, ফলে বাতাসে মাতাল নাচন তুলল কপ্টারটা। এবার রোটর ঘুরতে লাগল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। দ্রুত ওপরে উঠে বুলেটের আওতার বাইরে সরে এলো কপ্টার। জেনারেল হাশমীর পাশে হাঁটু মুড়ে বসল রানা।
‘ওদেরকে ইথিওপিয়া ছাড়া করবেন, আমার অনুরোধ…’ নিস্তেজ কণ্ঠে বললেন জেনারেল।
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন,’ আশ্বাস দিল রানা।
‘ওরা এখানকার লোক নয়, দেশদ্রোহী… ওদেরকে ছাড়বেন না…’
মুখে রক্ত তুলে মারা গেলেন জেনারেল।
রানা সামনে, পাইলটের কাছে গিয়ে মৃত্যুসংবাদটা জানাল।
‘ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাব আমি,’ বলল পাইলট।
‘না। আমাদের এখানে থাকতে হবে।’
‘জেনারেলকে আমি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।’ বেল্টে গোঁজা পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল লোকটা।
পাইলটের চোয়ালের নিচ বরাবর ডান হাতটা ল্যান্ড করল রানার। সীট থেকে পাইলটকে টেনে সরিয়ে কপ্টারের দখল নিল রানা। কপ্টারটা আমেরিকান, অচেনা নয়। কাজেই বাংলাদেশীরা না পৌঁছনো অবধি চক্কর কাটতে বেগ পেতে হলো না ওকে। নিচে এক বিঘা জমিতে শুয়ে আছে বিশাল মিসাইলগুলো।
মিনিট খানেকের জন্যে কন্ট্রোল ছেড়ে পাইলটের .৪৫ বাজেয়াপ্ত করল রানা ওর হোলস্টার থেকে। নিশ্চিত হলো একটা কার্তুজ রয়েছে চেম্বারে এবং সেফটি অফ। এরপর আবার বড় করে পাক দিতে লাগল ও। নিচে থেকে লক্ষ করছে ওকে ডানাকিলরা। পুব দিকে উড়ে যাওয়ার সময় ছোট্ট ফোর্সটাকে স্পষ্ট দেখতে পেল রানা।
পাইলট নড়তে চড়তে আরম্ভ করেছে। চোখ মেলে একদৃষ্টে রানার দিকে চেয়ে। এবার ওঠার চেষ্টা করল।
‘নোড়ো না,’ বলল রানা, .৪৫ দোলাল হুমকির ভঙ্গিতে।
‘তুমি আমাকে আক্রমণ করেছ,’ বলল লোকটা।
‘আমার লোকেরা না আসা পর্যন্ত আকাশেই থাকছি আমরা,’ বলল রানা। ‘আমার কথা মত চক্কর দিলে মারটা খেতে হত না।’ ওর আনুগত্য উস্কে দিতে চাইল রানা। ‘আর জেনারেলের শেষ আদেশ ছিল ওঅরহেডগুলো ইথিওপিয়া থেকে দূর করা…পাহাড়ে
ফিরে গেলে কিভাবে করব কাজটা?’
হঠাৎ বায়ুতরঙ্গে আঘাত করল কপ্টার। নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে দু’হাত ব্যবহার করতে হলো রানাকে। কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে চকিতে চাইতে ও দেখতে পেল উঠে পড়েছে পাইলট। টলমল পায়ে রাইফেলের র‍্যাকটার উদ্দেশে চলেছে। কপ্টারটা লাফ-ঝা না করলে এতক্ষণে গুলি করে বসত রানাকে। রানা সযত্মে লক্ষ্যস্থির করে ওর হাঁটুর পেছনে গুলি করল।
পড়ে গেল না, টলে উঠল পাইলট। একপাশে আবারও কাত হয়ে গেল কপ্টার। জেনারেল হাশমীর লাশ ডিঙিয়ে, খোলা দরজা দিয়ে বাইরে উড়ে গেল পাইলট। রানা এমনটা আশা করেনি। লোকটার বেঁচে থাকা দরকার ছিল। সুপিরিয়রদের সে তাহলে বলতে পারত মিসাইলের মাঝে লুকানো ডানাকিলদের কথা। ইথিওপীয়রা এখন রানাকে দুষতে পারে জেনারেল হাশমীর মৃত্যুর জন্যে।
মাইক্রোফোন তুলে নিয়ে আগুয়ান বাংলাদেশীদের কল করল রানা। ‘সঙ্গে আর্মড লোকজন আছে তো?’
‘বারো জন,’ প্রত্যুত্তর এল।
‘যথেষ্ট নয়, কিন্তু ওদের দিয়েই কাজটা সারতে হবে,’ মিসাইলের পাহারাদারদের কথা জানাল রানা।
‘বারো জন মেরিন এরা,’ টাস্ক ফোর্সের নেতা বলল। ‘ওদের ক্যারি করা কপ্টারগুলো আগে নামাব আমরা। আর তিন মিনিটের মধ্যে দেখা পাবেন আমাদের।’
‘বেশ,’ বলল রানা। ‘আপনাদের আগেই নেমে যাব আমি।
এত অল্প লোক নিয়ে ডানাকিলদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে কিনা, এ ব্যাপারে চিন্তিত ও।

মেরিন দলটি পৌঁছানোর আগেই কপ্টার নামিয়ে আনল রানা। কৌশলটা ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু মিসাইলের একপাশে ল্যান্ড করে, ডানাকিলদের হতচকিত করে দেবে আশা করছে ও। মিসাইলের কারণে কপ্টারের গায়ে গুলি করতে দ্বিধা করবে লোকগুলো। মালদিনির আদেশ ছাড়া কাজটা করবে না। ও নিশ্চিত জানে মালদিনি আছে কাছেই কোথাও। উন্মুক্ত মরুর বুকে কপ্টার নামিয়ে, হতবিহ্বল স্থানীয় লোকগুলো গুলিচালনা আরম্ভ করতে পারার আগেই, লাফিয়ে কপ্টার থেকে নেমে গেল রানা। শরীর ভাঁজ করে সরে গেল কপ্টারের কাছ থেকে।
উত্তপ্ত বালি আগুন ধরাচ্ছে দেহে। গানফায়ার ওপেন হতে কপ্টারের গায়ে বুলেট আছড়াতে শুনল রানা। এরপর ঘটল বিস্ফোরণ; ফুয়েল ট্যাঙ্কে বুলেট সেঁধোতেই সর্বাঙ্গে ছ্যাঁকা খেল যেন ও। μল করার চিন্তা বাদ দিয়ে, রাইফেল বুকে চেপে ধরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল রানা। যতটা পারে নুইয়ে রেখেছে শরীর।
অনুচ্চ এক ঢিবির পেছনে ডাইভ দিয়ে পড়ল ও। প্রায় একই সময়ে চারপাশ থেকে ছিটকে উঠল বালি; বাতাসে শিস কাটল বুলেট। রাইফেলটা স্থির করে, মাটিতে শরীর মিশিয়ে দিল ও। জনা বারো হবে, মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে বিস্ফারিত চোখে রানাকে লক্ষ করছে এক ডানাকিল গ্রুপ। মিসাইলের কাছাকাছি রয়েছে আরও দশ-বারো জনের মত। পাল্টা জবাব দিচ্ছে এখন রানা। রাইফেল খালি হলো দু’জনকে কাবু করে।
রাইফেলটা ব্যস্ত হাতে রিলোড করল রানা। কপ্টার থেকে নামার সময় রাইফেল র‌্যাক থেকে গুলির বাক্স নিয়ে এসেছে। রাইফেলটা দ্বিতীয়বারের মত অর্ধেকখানি খালি হয়ে এসেছে, আরেকজন ডানাকিল কুপোকাত, এমনি সময় কাছিয়ে আসতে লাগল রানার প্রতিপক্ষ। দেহ ভাঁজ করে খানিকদূর দৌড়ে এসে থামছে, একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় করে কভার দিচ্ছে। ঢিবির আরেকপাশে সরে গেল রানা। আরেক শত্রুকে হত্যা করে আবার
খালি হলো ম্যাগাজিন।
ক্রমেই কাছিয়ে আসছে ওরা, শীঘ্রিই অনিবার্যভাবে কেউ না কেউ হিট করবে রানাকে। অতি প্রিয় জানটা যাচ্ছে এবার, রানা যখন মেনে নিয়েছে, ঠিক তখুনি সকালের রোদ ফুঁড়ে বেরিয়ে এল বাংলাদেশী কপ্টারগুলো। গুলি চালাতে আরম্ভ করেছে মেরিন দল। পাঁচ মিনিটে শেষ হয়ে গেল যুদ্ধ। আর গুলি করার লোক খুঁজে পেল না রানা।
এক মেরিন সার্জেন্ট বালি মাড়িয়ে মন্থর পায়ে এগিয়ে এল, স্যালুট ঠুকে বলল, ‘আপনি নিশ্চয় মাসুদ সাহেব?’
‘আমিই সেই অধম, সার্জেন্ট,’ বলল রানা। ‘একদম কাঁটায় কাঁটায় পৌঁছেছেন। আর একটা মিনিট দেরি হলে আমাকে উদ্ধার করতে হত না।’
‘কারা ওরা?’
‘ডানাকিল। কখনও শুনেছেন ওদের কথা?’
‘জ্বী না, স্যার।’
‘ওরা দুনিয়ার দ্বিতীয় সেরা যোদ্ধা।’
মুখে হাসি ছড়াল সার্জেন্ট। ‘প্রথম কারা, স্যার?’
‘আমরা। বাংলাদেশের বাঙালীরা,’ নির্দ্বিধায় বলল রানা।
ভস্মীভূত কপ্টারটা আঙুল-ইশারায় দেখাল সার্জেন্ট। ‘আপনার সাথে কেউ ছিল নাকি, স্যার?’
‘ছিল একজন। কিন্তু মারা গেছে লোকটা। মিসাইল টেকনিশিয়ানদের কাজে লাগাতে কতক্ষণ লাগবে?’
এক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার বিভিনড়ব দেশের বিশজন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে এসেছেন। অগুনতি প্রশ্ন ছিল তাঁর, কিন্তু রানা সে সুযোগ দিল না তাঁকে।
‘সে লম্বা কাহিনী, কমান্ডার,’ বলল। ‘অত কথায় কাজ নেই। এ জায়গাটা ভাল নয়। বিদেশী লোক পেলেই খুনের নেশা চাপে এখানকার বাসিন্দাদের।’
পরিস্থিতি দ্রুত অনুধাবন করলেন কমান্ডার। মিসাইল থেকে ওঅরহেড খসাতে তখুনি লেগে পড়ল লোকেরা। গোটা পাঁচেক ওঅরহেড খুলে কপ্টারে তুলেছে এসময় পুব দিক থেকে গোলাগুলির শব্দ ভেসে এল। নৌবাহিনী অ্যাকশনে নেমে পড়ল কালবিলম্ব না করে, ওদিকে রানা মিসাইলের ছায়া ছেড়ে, সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে লুগার বের করল। আরও শব্দ হয় কিনা সেজন্যে অপেক্ষা করল ও, কিন্তু হলো না। হঠাৎ এক নৌসেনাকে দৌড়ে
আসতে দেখা গেল।
‘মাসুদ সাহেব,’ বলল। হাঁফাচ্ছে। ‘জলদি আসুন। এক পাগল মিসাইলগুলো ফাটাতে চাইছে।’
রানা শশব্যস্তে ছুটল ওর পিছু পিছু। ছোট এক ঢিবিতে চড়তে দেখা গেল, মোটা মত এক শ্বেতাঙ্গের হাতে একটা বাক্স। সোভিয়েতে তৈরি, মিশরের চুরি যাওয়া এক মিসাইলের পাশে দাঁড়িয়ে লোকটা। নির্ভুল প্রমাণিত হলো মাসুদ রানার অনুমান: রবার্তো মালদিনি ইথিওপিয়ারই কোথাও না কোথাও আছে।

মালদিনির পঞ্চাশ ফিটের মধ্যে দাঁড়িয়ে রানা, সহজেই লুগার ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, গুলি করার ঝুঁকিটা নিতে পারল না ও। মালদিনির হাতের বাক্সটা, এবং ওঅরহেডে জোড়া তারগুলো দেখার পর পারার কথাও নয়। অবিশ্বাস্য রকমের সাধারণ এক অস্ত্র। মালদিনি এখন কেবল একটা বোতাম কিংবা সুইচ টিপলেই হয়, ডানাকিলে ইতিহাসের বৃহত্তম ও ভয়ঙ্করতম আণবিক বিস্ফোরণ ঘটে যাবে।
‘ওটা হাত থেকে ফেলে দাও, রানা!’ চেঁচিয়ে বলল মালদিনি।
বালিতে উড়ে গিয়ে পড়ল রানার লুগার। সেই মুহূর্তে দুটো কাজ করতে চাইল রানা। একটা হচ্ছে মালদিনিকে খুন করা। দ্বিতীয়টা, লেফটেন্যান্ট কমান্ডারকে চিবিয়ে খাওয়া। লোকটা রানার কাছে দূত না পাঠালে, গোপনে মালদিনিকে আক্রমণ করার একটা সুযোগ পেত ও।
মালদিনি আদেশ দিল, ‘নাও, আমার দিকে আস্তে আস্তে হাঁটা ধরো।’
স্টিলেটোর কথা কি জানে না লোকটা? সম্ভবত জানে না, মনে মনে বলল রানা। স্টিলেটোর কার্যকারিতা দেখার সৌভাগ্য তো হয়নি মালদিনির অথবা তার লোকেদের।
একটা মওকা জুটে গেছে যা হোক। কিন্তু ফায়দাটা লুটবে কি করে রানা? মালদিনি ডান তর্জনী রেখেছে একটা টগ্‌ল্‌ সুইচের ওপর। রানা এতটাই কাছে, কটা তার আছে গুণতে পারল। দুটো তার ওই কালো বাক্সটা থেকে মিসাইলের মাথায় গেছে, ওটা মালদিনির ডান পাশে পেছন দিকে বিস্তার পেয়েছে-রানার বাঁয়ে-সাইন্স ফিকশন ছবির সরীসৃপের মত রোদ পোহাচ্ছে। কতখানি কাছে এগোতে দেবে ওকে মালদিনি অঙ্ক কষছে রানা।
‘ওখানে দাঁড়াও, রানা,’ বলে উঠল লোকটা।
দশ ফিট। থেমে পড়েছে রানা। দুপুর উতরেছে সবে, ভারী জুতো-মোজা মানছে না তপ্ত বালি, সোল ভেদ করে পুড়িয়ে দিচ্ছে ওর পায়ের পাতা।
‘এবার এই যে, তোমরা…!’ চিৎকার থামিয়ে রানার দিকে কটমট করে চাইল মালদিনি। ‘রানা, ডান দিকে সাবধানে দু’পা সরো।’
আদেশ পালন করল রানা। নৌবাহিনীর সদস্যদের এখন আর দেখতে বাধা নেই মালদিনির। ওদের মধ্যে কারও এখন বীরত্ব চেগিয়ে না উঠলেই বাঁচি, আত্মগতভাবে বলল রানা। মালদিনিকে পেড়ে ফেলতে পারবে ওরা অব্যর্থ লক্ষ্যে, কিন্তু লোকটার আঙুলের ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত ক্ষীণতম টোকায় নেমে আসবে কেয়ামত।
‘যাওয়ার জন্যে তৈরি হও!’ বলল মালদিনি ওদের উদ্দেশে। ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে কপ্টার যেন আকাশে ওড়ে।’
আস্ত পাগল লোকটা, আর কোন সন্দেহ রইল না রানার। ওঅরহেডে সংযুক্ত ডিটোনেটর ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র নেই মালদিনির কাছে। রানাকে আটক করার কোন সুযোগই তার নেই। মিসাইল ফাটিয়েই কেবল রানাকে ও নিজেকে সে খুন করতে পারবে। লোকটা তার ভয়ঙ্কর, রেডিও অ্যাকটিভ আত্মহত্যার সাথী হওয়ার জন্যেই বুঝি ডেকে পাঠিয়েছে রানাকে।
কিন্তু বিকল্প সুযোগের যে কমতি রয়েছে তা কি বুঝতে পারছে পাগলটা? দরদর করে ঘাম গড়াচ্ছে রানার সর্বাঙ্গে। তিন মিনিট, বড়জোর চার মিনিট পাবে রানা উন্মাদ লোকটার মনের মধ্যে প্রবেশ করার জন্যে, তার পরিকল্পনা আবিষ্কার করে, ব্যর্থ করে দিতে। কালান্তক ওই কালো বাক্সটা হাত থেকে ফেলে দেয়ার আগেই কিছু একটা করতে হবে রানাকে। এক্ষুণি।
‘আমাদের জ্বালাতন না করে যুদ্ধের জন্যে অন্য কোন দিন বেছে নাও। সরকারের ভেতর তোমার বন্ধুরা তো রয়েছেই,’ কথার পিঠে কথা বলার সুরে বলল রানা।‘ডানাকিলদের মধ্যে তোমার ভাল প্রভাব আছে একথা সত্যি।’
রানা চাইছে না সহসা বাস্তবে ফিরে আসুক মালদিনি। আজকের যুদ্ধে ডানাকিলরা পরাজিত হবে কল্পনাও করেনি লোকটা। ভেবেছিল জেনারেল হাশমীর কপ্টার অ্যামবুশ করে, তারপর ন্যাভাল টাস্ক ফোর্স ল্যান্ড করতে না করতেই তাদের নিশ্চিম করে দেবে। কিন্তু অত্যুৎসাহী এক ডানাকিল হাশমীকে দেখামাত্র গুলি করে বসে। এখন আর মালদিনির পিছু হটার রাস্তা নেই। ব্যাপারটা বুঝলেই সেরেছে, সুইচ টিপে, ইলেকট্রিক্যাল কারেন্ট তারের মাধ্যমে চালান করে দেবে ওঅরহেডের ওই টার্মিনালগুলোয়।
তার? রানা ত্বরিত পরখ করে নিল ওগুলো। ওর জীবন বাঁচাবে এগুলো, আশা করছে রানা। প্রত্যেকটা তার মিশেছে গিয়ে ছোট ছোট মেটাল ক্লিপে, টার্মিনালের স্ক্রু হেডের নিচ দিয়ে স্লাইড করা হয় যেগুলোকে। হেডের কাছে সব কটাকে জড়িয়ে দিয়েছে মালদিনি। সন্দেহ না জাগিয়ে যতখানি সম্ভব কাছ থেকে নিরীখ করে নিল রানা। একটা, টপ টার্মিনালটার সঙ্গে সংযুক্ত, ক্লিপের মাত্র দুটো পয়েন্টের সঙ্গে কন্ট্যাক্ট পাচ্ছে। একটু জোরে টান দিতে পারলে তার সার্কিট ব্রেক করবে এবং ডিটোনেশন হয়ে পড়বে অসম্ভব। এখন রানার কাজ হচ্ছে, লোকটা সুইচ টিপে দেয়ার আগেই যাতে থাবা মারতে পারে ওটায়, এমনি অবস্থান নেয়া।
এক পা আগে বাড়ল ও।
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও!’ চেঁচাল মালদিনি।
টাস্ক ফোর্স টেক অফের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে, কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে কপ্টারগুলোর এঞ্জিন।
‘দুঃখিত,’ মৃদু স্বরে বলল রানা। ‘পায়ে খিল ধরে গেছে আমার। ওই ইথিওপিয়ান কপ্টারটায় এত বেশি যন্ত্রপাতি ছিল, পা ছড়িয়ে বসার জো ছিল না।’
‘পিছিয়ে যাও।’
বাঁয়ে, পেছনে সরে গেল রানা, চাইলেই এখন ওঅরহেড স্পর্শ করতে পারবে। বিদায়ী প্রতিপক্ষ ও রানাকে একই সঙ্গে লক্ষ করতে হলে মালদিনিকে সরে যেতে হত মিসাইলের কাছ থেকে। কিন্তু সরেনি সে। তারমানে ইলেকট্রিকাল কানেকশন যে ঢিলে, নিজেও জানে। অবশ্য জানলেও কিছু করতে পারবে কিনা সন্দেহ।
এমুহূর্তে কপ্টারের শোরগোল ছাপিয়ে চেঁচিয়ে উঠল রানা। ‘জুলেখার কথা মনে আছে, মালদিনি?’
‘ওকে ফেরত পাব,’ বড়াই করে বলল লোকটা। ‘ওকে ওরা আমার কাছে পাঠাবে আর নয়তো পৃথিবীর ম্যাপ থেকে মুছে দিয়ে যাব এদেশের নাম।’
‘একবার পাখি খাঁচাছাড়া হয়েছে আর কি ফেরত আসবে?’ উস্কে দিল ওকে রানা। ‘তাছাড়া তোমার মত একটা বদ্ধ পাগলের কাছে আসতে যাবেই বা কেন?’
রানার মুখে পাগল শুনে মাথায় রক্ত চড়ে গেল লোকটার। কয়েক পা এগিয়ে এল সে রানার উদ্দেশে, ডান হাতে আলগা হয়ে ঝুলছে কালো ডিটোনেটর বক্সটা, টগ্‌ল্‌ সুইচের সিকি ইঞ্চি দূরে ওর আঙুল। আরেকটু কাছে এলে সুবিধে হত, কিন্তু কি আর করা।
সামনে ঝাঁপ দিল রানা।
আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে বাঁ হাত উঠে গেল লোকটার। যখন বুঝল রানার লক্ষ্য সে নয়, তার, তখন আর কিছু করার নেই। তারে উড়ে গিয়ে পড়েছে রানার দেহ। বাতাস হাতড়ানো হাত দুটো ওর খুঁজে পেয়েছে ওগুলো। গড়ান দিয়েই সটান দাঁড়িয়ে গেল রানা। সবচেয়ে ওপরের ওয়্যারটা, রানা যেটাকে দুর্বলতম ধারণা করেছে, এক হ্যাঁচকা টানে উঠে এল ওঅরহেডের টার্মিনাল থেকে।
মালদিনি পেছন থেকে মুখ খারাপ করছে শুনতে পাচ্ছে রানা। ঘুরে দাঁড়াতে, টগ্‌ল্‌ সুইচটাকে বৃ া আগু-পিছু করতে দেখল সে লোকটাকে। জুড়ে থাকা একমাত্র তারটা সর্বশক্তিতে টান মারল রানা। ওটাও খুলে এল ওঅরহেড থেকে। মালদিনির হাতের ডিটোনেটরটা এখন আর কিছুর সঙ্গেই না, কেবল ডানাকিল মরুভূমির বালির বুকে সংস্পর্শ পাচ্ছে।
উড়াল দিয়েছে কপ্টারগুলো। রানা আশা করছে অনেকেই ওপর থেকে দেখতে পাবে ওকে, এবং নেমে আসবে কপ্টার। সুইচ অ্যাকটিভেট করার চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়ে হিংস্র চোখে রানার দিকে চেয়ে রয়েছে মালদিনি।
‘শুয়োরের বাচ্চা!’ রাগে ফেটে পড়ল লোকটা। রানা ঈষৎ ঝুঁকে এগিয়ে গেল ওর দিকে। মালদিনি অকেজো ডিটোনেটরটা ছুঁড়ে মারল রানাকে লক্ষ্য করে। মাথা নোয়াল রানা। মালদিনি সেই সুযোগে নরম, অস্থির বালির ওপর দিয়ে ছুটতে শুরু করল। কিন্তু পালিয়ে যাবেটা কোথায়? রানার শরীরটা ডাইভ দিয়ে গিয়ে পড়ল লোকটার পিঠের ওপর।
‘বাপ রে!’ অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল মালদিনি। ঘাড়ে মোক্ষম এক রদ্দা কষে ওকে অজ্ঞান করে দিল রানা।
মাথার ওপর গোঁ-গোঁ করছে হেলিকপ্টার।

কপ্টারে তোলা হচ্ছে ওঅরহেডের যন্ত্রাংশ। অচেতন মালদিনিকেও তোলা হয়েছে। সুপ্রাচীন, ভূপাতিত গাছের মত মরুর কোলে পড়ে রয়েছে মিসাইলগুলো। তাজা থাকবে বহুদিন, কেউ খুঁজে পাক বা না পাক।
‘মাসুদ সাহেব,’ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার খন্দকার বোরহান বললেন, ‘কে এই মালদিনি?’
‘প্রতিভাবান এক উন্মাদ। ও পূর্ব আফ্রিকার সম্রাট হয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধাতে চেয়েছিল। ওই ওঅরহেডগুলো কায়রো, দামেস্ক আর তেল আবিবে টার্গেট করেছিল।
‘উন্মাদ কোন সন্দেহ নেই। আমাদের সবাইকে ছিন্নভিন্ন করে দিতেও বুক কাঁপত না ওর। একটা ওঅরহেডই যথেষ্ট ছিল এজন্যে, কিন্তু চেইন রিয়্যাকশন রেডিও অ্যাকটিভ ফলআউট ঢেকে দিত দুনিয়ার এ অংশটুকু।’
রেড সি-র মাঝামাঝি পৌঁছেছে কপ্টার।
মরুভূমিতে চোখ রাখল রানা, গোধূলীলগেড়ব ধু-ধু বালির প্রান্তর
অস্পষ্ট হয়ে এসেছে প্রায়। ডানাকিলদের উটের কাফেলা, মরুর
বুকে পথ করে নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে এগিয়ে চলেছে, দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে
পেল রানা। এবার হঠাৎ জুলেখার কথা মনে পড়ল ওর। নিজের
অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মাসুদ রানার বুকের ভিতর
থেকে।

***
(সমাপ্ত)

গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দুঃখিত!