কান্তার মরু – ১২ –মাসুদ রানা

ছোট্ট মিলিটারী এয়ারফিল্ডে রানাকে আমন্ত্রণ জানালেন জেনারেল হাশমী তাঁর আক্রমণ পর্যবেক্ষণ করার জন্যে। যুদ্ধের জন্যে তৈরি ও কষ্টসহিষ্ণু মনে হলো ওদের দেখে। আমহারিক গোত্র থেকে এসেছে বেশিরভাগ, এবং রানার ধারণা হলো, ইথিওপিয়ার জাতিগত সমস্যার কথা মাথায় রেখে, এদের বাছাই করতে হয়েছে ভদ্রলোককে। ঝটপট রওনা হয়ে গেল ওরা।

মাখনের মত মসৃণ হলো মিলিটারী অপারেশনটা। জেনারেলের কপ্টার থেকে লক্ষ করল রানা, অ্যাটাক ফোর্সের তিন আর্মস গিলে নিল ডানাকিল গ্রামটাকে। এবার মালদিনির হেডকোয়ার্টারমুখো হলো ওরা, এবং পাক্কা বিয়াল্লিশ মিনিটের মাথায় ক্যাম্পের মাথার ওপর অবস্থান নিল।
রেডিও থেকে আমহারিক ভাষার বিস্ফোরণ শোনা গেল। জেনারেল হাশমী তাঁর মাইক্রোফোন তুলে নিয়ে এক ঝাঁক আদেশ দিলেন।
‘ওরা মিসাইল বের করছে,’ বললেন। ‘আমরা এখন ওদের চমকে দেব।’
তিনটে জেট, রকেট ও নাপাম ওগরাচ্ছে, ঝাঁপিয়ে বেরিয়ে এল সূর্যের আড়াল থেকে। আরও ছটা ফাইটার-বম্বার অনুসরণ করছে ওগুলোকে। মালদিনির দুটো মিসাইলসাইট থেকে ধোঁয়ার তরঙ্গ উঠতে দেখল রানা। একটি উত্তরে, ওর ক্যাম্প আর ডানাকিল গ্রামটার মাঝখানে, এবং অপরটা ক্যাম্পের দক্ষিণ দিকে। মাটিতে মিশে গেল পপি খেত। দু’ জায়গায় চাষ করেছিল ডানাকিলরা। গোটা দুই নাপাম পড়তেই, কপ্টারের উদ্দেশে গুলিবর্ষণরত লোকগুলো যে যেদিকে পারে ছুটে পালাতে লাগল। দক্ষিণে বিকট এক বিস্ফোরণ কমান্ড কপ্টারটাকে বাধ্য করল উন্মাদের মত গতিপথ পরিবর্তন করতে।
‘এই বুদ্ধুগুলো কোন ফেইল-সেফ যন্ত্র হাতাহাতি না করলেই বাঁচি,’ বলল রানা।
‘অ্যাটমিক বিস্ফোরণ হলে মারা পড়ব আমরা,’ সায় জানালেন হাশমী। ‘তাও মধ্যপ্রাচ্যের কোন বড় শহরের চাইতে এখানে থাকা ভাল।’
অ্যাটমিক বিস্ফোরণ ঘটল না। জেনারেল আদেশ করলেন মালদিনির ক্যাম্পের মাঝ বরাবর কপ্টার নামাতে। কাছের এক গিরিখাতে আশ্রয় নিয়েছে বিদ্রোহীদের শেষ দলটা। তাদের দমন করতে গুলিবর্ষণ করতে করতে ছুটে গেল গানশিপ।
‘দলছুটদের দিকে লক্ষ রাখবেন,’ সতর্ক করে দিয়ে, হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করলেন হাশমী।
জ্যাকেট খুলে হাতে নিয়ে এল রানা লুগারটা। ওটার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন জেনারেল। বাহুর খাপে পোরা স্টিলেটোটার উদ্দেশে ইঙ্গিত করলেন। ‘আপনি যুদ্ধসাজে সেজেছেন দেখতে পাচ্ছি।’
যুদ্ধ করতেও হলো। মালদিনির ভস্মীভূত তাঁবুর দিকে পায়ে হেঁটে এগোতেই ওদের লক্ষ্য করে গুলি শুরু হলো। ক্রীতদাসীদের কম্পাউন্ডের আশপাশের পাথরগুলোর মাঝ থেকে গুলি করছে ছোট্ট একটা ডানাকিল গ্রুপ। পাল্টা গুলি বিনিময় করল ওরা। রেডিও অপারেটরের উদ্দেশে হাঁক ছাড়লেন জেনারেল। একটু পরেই, উপত্যকার দক্ষিণপ্রান্ত থেকে অল্প ক’জন সৈন্যের একটা দল এসে, হ্যান্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে দিতে লাগল। আত্মরক্ষাকারীদের একজনকে রানাদের অবস্থান লক্ষ্য করে ধেয়ে আসতে দেখা গেল। লুগার পেড়ে ফেলল ওকে। এই একটা গুলিরই সুযোগ পেল রানা সারা দিনে। আরেক পশলা গ্রেনেড হামলার পর সৈন্যরা তেড়ে গেল পাথরস্তূপ লক্ষ্য করে। মাত্র কয়েক মুহূর্ত, তারপরই সব খেল্‌ খতম।
জেনারেল হাশমী উঠে দাঁড়িয়ে ইউনিফর্মের ধুলো ঝাড়লেন। ‘চলুন, মিস্টার রানা, আমাদের স্বঘোষিত জেনারেলটিকে খুঁজে বের করা যাক।’
তাঁবুতে তনড়ব তনড়ব করে তল্লাশী চালাল ওরা। বেশ কিছু ডানাকিল ও ইউরোপীয়র লাশ দেখা গেলেও জেনারেল মালদিনি তাদের মাঝে নেই। হাতে গোনা বন্দী ক’জনের মধ্যেও পাওয়া গেল না তাকে।
‘ডানাকিলগুলোর মুখ খোলাতে বেশ সময় লাগবে,’ বললেন জেনারেল হাশমী।
সরকারী লোকেরা সাধ্য সাধনা করুক, রানা ঘুরে বেড়াতে লাগল এলাকাটার চারধারে। ক্রীতদাসদের মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল, তারপর আবার জড় করে প্রহরাধীন রাখা হয়েছে। রানার তাঁবুতে ছিল যে দুই জার্মান, তাদের দেখে অফিসার ইন চার্জের কাছে কথা বলার অনুমতি চাইল ও। রানাকে স্যালুট করে কথা বলতে দিল অফিসার।
‘মালদিনি কোথায়?’ প্র ম প্রশ্ন ছুঁড়ল রানা।
‘তুমি যাওয়ার ক’দিন পর সে চলে গেছে,’ জানাল একজন।
‘কুদরত চৌধুরী কেমন আছে?’
‘মারা গেছেন। মালদিনি কোথায় গেছে?’
‘জানি না। ও আর সাচ্চি কাফেলা তৈরি করে, ম্যাকলিনকে সাথে নিয়ে চলে গেছে।’
রানার যা জানার জানা হয়ে গেল, কিন্তু জেনারেল হাশমী বাকি দিনটা ডানাকিলদের নির্যাতন করে এর সত্যতা স্বীকার করালেন।
‘মালদিনি এখন সাগরে,’ বললেন জেনারেল। ‘ইথিওপিয়ার মাটিতে আর সে নেই।’
‘তাতে ইথিওপিয়ার সমস্যা কাটছে না,’ রানা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল।
‘আমরা নিরপেক্ষ দেশ। বড় কোন নৌবহর নেই যে সর্বক্ষণ সাগর পাহারা দেব। কি করতে বলেন আমাদের?’
‘কিছুই না,’ বলল রানা। ‘আপনার লোকেরা-আপনাদের এয়ারফোর্স চমৎকার কাজ দেখিয়েছে। এখন আপনার বা আমার একার পক্ষে সাঁতরে গিয়ে মালদিনির জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া সম্ভব না। তাছাড়া আমার বিশ্বাস শেপ মাইয়ার ইথিওপীয় জেটের আওতার বাইরে চলে গেছে। আসমারা ফিরে বসের সঙ্গে আলাপ করে দেখি কি করা যায়।’
বাইরে শান্ত-সংযত ভাব বজায় রাখলেও, বিলম্বের জন্যে মনে মনে হাশমীর অহংবোধকে অভিশাপ দিচ্ছে রানা। যত জলদি রাহাত খানকে মালদিনির অন্তর্ধান সম্পর্কে জানানো যায়, তত তাড়াতাড়ি শেপ মাইয়ারের বিরুদ্ধে পরবর্তী কর্মপন্থা ছকে ফেলা যাবে। কিন্তু খোলামেলা রেডিও সার্কিটে এ নিয়ে আলাপ করতে পারছে না রানা। কোড ব্যবহার করলেও মুশকিল, অপমানিত বোধ করবেন হাশমী। লোকটা এখানে ছড়ি ঘুরিয়ে যদি আত্মতৃপ্তি লাভ করে, করুক না।
‘সাধারণ বুদ্ধিতে বলে,’ আসমারায় ফিরে এলে সন্ধেবেলা রানাকে বললেন বস, ‘মালদিনির নিজস্ব নৌবাহিনী নেই, এবং শেপ মাইয়ারে গিয়ে চড়েছে সে। খোলা আটলান্টিকে আছে লোকটা, সমস্ত ট্রেড রুটের সীমানার বাইরে। মিশরীয় একটা ক্যারিয়ার আর চারটে ডেস্ট্রয়ার ছায়া দিচ্ছে ওটাকে। আর দুটো সিরিয়ান সাবমেরিন কভার করছে আফ্রিকান উপকূল।’
‘আমার অনুমান শেপ মাইয়ার আর্মড,’ বলল রানা। দুটো আলাদা সুপারস্ট্রাকচার এবং লোয়ার ডেকের বিশাল এলাকা সম্পর্কে জানাল সে বসকে।
‘থ্রি-ইঞ্চ গান,’ মাথা ঝাঁকালেন রাহাত খান। ‘বিসিআই তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েই ডাটা সংগ্রহ করতে শুরু করে।’
‘মালদিনি জাহাজে আছে নিশ্চিত হব কিভাবে?’
‘হুঁ।’ চিন্তামগড়ব হলেন মেজর জেনারেল রাহাত খান।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!