তিনদিন বাদে, প্রায় কারবালার দশা নিয়ে ভিনড়ব ধরনের এক অঞ্চলে প্রবেশ করল রানাদের কাফেলা। অগুনতি পাথুরে পাহাড় চারধারে। ছোটখাট ঝোপ-ঝাড়েরও ছড়াছড়ি লক্ষ করা গেল। উটচালক ও গার্ডদের মুখের হাসি বলে দিল কাছেই পানির ব্যবস্থা রয়েছে। যাত্রাটা খুব সোজা ছিল না। আরও দুটো উট খোয়াতে হয়েছে। বালির ওপর একবার যে শুয়েছিল, ওরা মাল খালাস করার পরও আর উঠতে রাজি হয়নি।
ছোট্ট ডোবাটার পানিতে গাঁজলা। পাথুরে এক অবতলে, আশপাশে খুদে খুদে ঝোপ-ঝাড় নিয়ে অবস্থান ওটার। পানিতে ক্ষারের স্বাদ। চালকদের মরু-জ্ঞান বলছে এপানি খাওয়া চলে, রানার কাছে যদিও দুনিয়ার সবচাইতে সুস্বাদু-সুপেয় জল মনে হলো একে। অভিযানের প্র মার্ধে বেজায় হিসেব করে পানি দেয়া হয়েছিল ওদের, এবং শেষের তিনদিন পানির অভাবে ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেছে শরীর।
উটগুলো আকণ্ঠ পান করে তাজ্জব করে দিল রানাকে। ডোবার পানির স্তর এতই দ্রুত নামিয়ে দিল যে মনে হলো, কোন পাতালনদী ডোবার পানি শুষে নিচ্ছে বুঝি। আর কোন স্থলচর প্রাণী হলে এত পানি একসঙ্গে পান করে নির্ঘাত মারা পড়ত। কিন্তু এদের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সাধে কি আর মরুর জাহাজ বলে এদেরকে?
‘রাতে এখানে ক্যাম্প করব আমরা,’ রানাকে বলল সাচ্চি। ‘সকালে ডোবা ভর্তি হলে ক্যান্টিন ভরে নেব।’
‘আর কেউ পানি চাইলে তখন?’
হেসে উঠল সাচ্চি। ‘সিংহ?’
‘মানুষও হতে পারে।’
রাইফেলে চাপড় দিল সাচ্চি। ‘বেশি লোক এলে আবারও রাইফেল হাতে পাবে তুমি।’
সে রাতে দুটো অগিড়বকুণ্ড জ্বালা হলো। চালক, গার্ড ও বন্দীদের জন্যে একটা, আর অপরটা সাচ্চি ও তার পেয়ারের লোকেদের জন্যে। রানাকে আমন্ত্রণ জানাল লোকটা।
‘দু’দিনের মধ্যে মালদিনির কাছে পৌঁছচ্ছি আমরা,’ বলল।
‘কে মালদিনি?’
‘জানো না?’
‘গুজব শুনেছি শুধু।’
‘গুজব,’ আগুনে থুথু ফেলল সাচ্চি। ‘জেনারেল মালদিনি সম্পর্কে কাফেলার লোকজন ভুলভাল কথা বলে। অনেক বছর আগে, আমাদের গ্রামে আসে জেনারেল। আমরা মেরে ফেলতে পারতাম তাকে, কিন্তু আমাদের শহরবাসী কিছু গোত্রীয় লোক বন্ধুত্ব করতে বলে তার সাথে। জেনারেল মালদিনি প্রতিশ্রুতি দেয় তাকে সাহায্য করলে আমাদের সম্পদ আর ক্রিতদাস দেবে। কাজেই তাকে সাহায্য করি আমরা।’
‘সম্পদ পেয়েছ?’ জিজ্ঞেস করল রানা। জবাবে মাথা ঝাঁকিয়ে, হাতের দোলায় ক্যারাভান দেখাল সাচ্চি।
নারী কণ্ঠের আর্তনাদ শোনা গেল হঠাৎ অপর অগিড়বকুণ্ডটার কাছ থেকে। ঘনীভূত আঁধার ভেদ করে চোখ কুঁচকে চাইল রানা। তিন ক্রীতদাসীকে বাধ্য করা হচ্ছে কাপড় খুলতে, এবং কয়েকজন পুরুষকে দেখা গেল ওদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে। সাচ্চির দিকে
চাইল রানা। দৃষ্টিক্ষেপ করল না লোকটা।
‘ওরা ক্রীতদাসী,’ বলল সাচ্চি, ‘একাজের জন্যেই কেনা হয়েছে ওদের। জেনারেল মালদিনি বেশ কিছু সাদাচামড়ার মানুষ আমদানী করেছে। তাদের মেয়েমানুষ দরকার হয়। এরা মালদিনির সম্পত্তি।’
‘তোমার নিশ্চয় ভাল লাগে না এসব?’
‘যোদ্ধা ভালবাসে তার মেয়েমানুষ, অস্ত্র আর উট। আমার পূর্বপুরুষরা কবে থেকে এখানে বাস করে কেউ জানে না, আমরা জানি জেনারেল যত লোক নিয়ে এসেছে তাদের জায়গা এখানে হবে না। উত্তরের আমহারিক খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে সবসময় লড়ে নিজেদের আবাস ভূমি রক্ষা করতে হয় আমাদের। জেনারেল মালদিনির যে-সব লোকেরা আজব ওই অস্ত্র বানাচ্ছে তাদের সঙ্গে লাগতে চাই না আমরা। যাকগে, ম্যাকলিনের জাহাজে উঠেছিলে কেন তুমি?’
‘জেনারেল মালদিনির পরিচয় জানার জন্যে।’
‘জানবে।’ নীরস হাসি হাসল সাচ্চি। ‘আরও অনেকে জানতে চেয়েছে। কেউ কেউ জেনারেলের দলে যোগ দিয়েছে। বাকিরা মৃতদের দলে। আমি আশা করব তুমি তার সাথে যোগ দেবে।’
জবাব দিল না রানা। ‘কি, দেবে?’ প্রশ্ন করল সাচ্চি।
‘না, সাচ্চি,’ বলল রানা। ‘ওর প্ল্যান সম্পর্কে তোমার আশঙ্কায় ভুল নেই। শত্রুরা এক সময় না একসময় জেনারেলকে খুঁজে বের করে খতম করবেই করবে। সঙ্গে মারা পড়বে তাকে যারা সাহায্য করছে তারাও।’
‘আমার লোকদের কথা বলছ?’ জবাব চাইল সাচ্চি। মাথা নেড়ে সায় জানাল রানা।
আগুনে আরেক দলা থুথু ফেলল সাচ্চি। ‘আমার বাপের আমলে ইতালিয়ানরা এদেশে এসেছিল। পে−ন, বোমা, এসব ছাড়াও নানান আজব অস্ত্র ছিল তাদের কাছে। পাহাড়ে, আমহারিক খ্রিস্টানদের শাসন করেছে তারা। আমাদের দক্ষিণে, গালা শাসন করেছে। কিন্তু অ্যাফার, মানে আমাদের লোকেরা যুদ্ধ করেছে। মরুভূমিতে এসে মরেছে ওরা। এটা ধ্রুব সত্য। বিদেশী লোক যখনই ডানাকিলে অনুপ্রবেশ করেছে, মারা পড়েছে।’
একটু পরে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে রানাকে বিদেয় করল সাচ্চি। অন্যান্য পুরুষ ক্রীতদাসদের কাছে, নিজের জন্যে বরাদ্দ জায়গায় চলে এল ও।
সে রাতে তিনবার ঘুম ভাঙল রানার। একবার ক্রীতদাসী দু’জনের চিৎকারে, আরেকবার এক সিংহের গর্জনে। তৃতীয়বার ভাঙল কোন কারণ ছাড়াই। প্রতিবারই, সজাগ ছিল সাচ্চি।
মালদিনির প্রকাণ্ড তাঁবুতে ক্রীতদাসদের জন্যে চারটে কম্পাউন্ড, ঘেরা তিনটে ও অন্যটা মহিলাদের। কাঁটাতারের বেড়া দেয়া নিচু, পাথুরে পাহাড়ের উপত্যকায় তৈরি করা হয়েছে ওগুলো। নেতাদের অর্থাৎ স্বাধীন মানুষদের জন্যে তাঁবু খাটানো হয়েছে ঝোপগুচ্ছ ও ঝর্নার ধার ঘেঁষে। রাস্তাটা চিনে নেয়ার সুযোগ পেল না রানা। একদল ডানাকিল দৌড়ে এসে ক্যারাভান ঘিরে ফেলল। সাচ্চির সঙ্গে কথাবার্তা বলছে।
ওদের ভাষা রানার অজানা। কিন্তু সাচ্চির দেহভঙ্গি ও রানার উদ্দেশে চকিত চাহনি বলে দিল যুদ্ধের বর্ণনা দিচ্ছে সে। গার্ডদের একটা গ্রুপ রানাকে দ্রুত এক ক্রীতদাস কম্পাউন্ডের দিকে সরিয়ে নিয়ে গেল। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে আদেশ করল।
‘তুমি নিশ্চয়ই সেই আমেরিকান,’ বলে উঠল এক ব্রিটিশ কণ্ঠ, ডান পাশ থেকে।
ঘুরে দাঁড়াল রানা। খোঁড়া এক লোক ক্রাচে ভর দিয়ে এগিয়ে এল। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিচয় পর্ব সারা হলে জানা গেল লোকটার নাম টনি গ্রেগ।
‘তুমি নাকি বিসিআই না কিসের স্পাই শুনলাম। তোমার সাথের মহিলাটি কোথায়?’
রানা কাফেলা আক্রমণের বৃত্তান্ত জানাল।
‘রক্ত পিপাসু, ওই ডানাকিল শালারা,’ বলল লোকটা। ‘পাঁচ বছর আগে ওদের হাতে ধরা পড়ি আমি। ইথিওপিয়ান আর্মি পেট্রলের উপদেষ্টা ছিলাম, ঠোকাঠুকি বাধে মালদিনির ছেলেদের সাথে। পা-টা তখনই খোয়াই। একমাত্র আমিই বেঁচে আছি, আমাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে আর কি, আমাকে দিয়ে ফুট-ফরমাশ খাটিয়ে বোধহয় আমোদ পায় মালদিনি।’
ওর প্রতি সহানুভূতি অনুভব করল রানা। ‘স্পাই, একথা আমি স্বীকার করছি,’ বলল। ‘মালদিনির মতলবটা কি শিয়োর হতে পাঠানো হয়েছে আমাকে।’
‘পুরো দুনিয়াটা দখল করে নেবে,’ সশব্দে হেসে উঠল টনি গ্রেগ। ‘শিগ্গিরই বলবে তোমাকে এসব কথা। তা, ধরা পড়লে কিভাবে?’
জাহাজে কভার ফাঁস হয়ে যাওয়ার কাহিনী শোনাল রানা। জানাল, বিপদটা শুরু হয় জিওনিস্টের এজেন্টটিকে মারধর করে সাগরে ফেলে দেয়ার পর থেকে।
‘ইসরাইল এসবের সাথে জড়িত নয়, মিস্টার রানা,’ বলল টনি। ‘এজায়গাটার কথা জানতে পারলে তোমার দেশের মত ওরাও এটাকে নিশ্চিম করতে দ্বিধা করবে না। ক’সপ্তাহ আগে এক ইসরাইলী স্পাই ছিল এখানে, সে-ই তো খেপিয়ে তুলল জেনারেল
মালদিনিকে।’
টনির সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কম্পাউন্ড দেখল রানা। পরিচিত হলো ক’জন আমহারিক ও সবকজন বন্দীর সঙ্গে-দু’জন জার্মান, এক সুইড, আর রাহাত খানের পরিচিত সেই কুদরত চৌধুরী। ভদ্রলোককে চেনে এমন ভাব দেখাল না ও। এরা সবাই ডানাকিলে
এসেছিল মালদিনি ওদের চাকরি দেবে ভেবে, কিন্তু ক্রীতদাস হয়ে পচে মরছে।
‘খুব ভাল লোক মনে হচ্ছে,’ টনিকে বলল রানা।
‘সত্যিই তাই, যদি ষড়যন্ত্র না করে অনুগত থাকতে পারো।’
ডিনারের পর, মালদিনির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেল রানা। পূর্বধারণা ইচ্ছে করেই উপেক্ষা করেছে ও। একমাত্র যে ছবিটা ও দেখেছিল, কয়েক বছর আগে তোলা, তাতে কঠোর চেহারার, কোটরাগত চক্ষু একজন রাজনীতিকের সাক্ষ্য মেলে। রোদে থাকতে থাকতে গায়ের রং তামাটে হয়ে গেছে এখন ওর, এবং চোখজোড়া যেন নিশ্চ্রাণ প্রায়।
দু’জন গার্ড রানাকে নিয়ে এলো তার সামনে।
‘বসুন, মিস্টার রানা,’ আমন্ত্রণ জানাল মালদিনি। নিচু টেবিলটার এপাশে মুখোমুখি বসল রানা। রাইফেলধারী গার্ড দু’জনকে বিদেয় করে দিয়ে একই সঙ্গে কোমর থেকে পিস্তলটা
বের করে হাতের নাগালের মধ্যে রাখল লোকটা।
‘সাচ্চির মুখে জানতে পারলাম, আপনার কারণেই নাকি শেষ কাফেলাটা এসে পৌঁছুতে পেরেছে,’ বলল মালদিনি। ‘সেদিক দিয়ে আমি হয়তো আপনার কাছে ঋণী।’
‘আমি নিজের জীবন বাঁচিয়েছি,’ বলল রানা। ‘ওই ডাকাতগুলো আমাকে মুক্ত করতে আসেনি।’
‘খাঁটি সত্যি কথা। ওয়াইন?’
‘ধন্যবাদ,’ বলল রানা। বাঁ হাতে গেলাসে তরল ঢেলে, মালদিনিকে ওর দিকে সাবধানে ঠেলে দিতে দেখে সতর্কতার মাত্রাটা বুঝল। লাল পানীয় ছলকে পড়ে যাওয়ার দশা, এতটাই গভীর মনোযোগে রানাকে লক্ষ করছিল লোকটা।
‘ম্যাকলিন বলছিল আপনি নাকি খুব ডেঞ্জারাস লোক, যদিও বারে বারে বলেছে, রেডিও অপারেটরকে আপনি মারধর করেননি। মেয়েটাও কিছু বলেনি। হয়তো ঘুমের ঘোরে টলে পড়ে ব্যথা পেয়েছে। যাকগে, এখানে এলেন কেন?’
‘ইথিওপিয়ান সরকার আমাদের সাহায্য চেয়েছে।’
‘কেজিবির বা জিওনিস্টের সাথে কাজ করছেন?’
‘না, কিন্তু তারাও আপনার প্রতি আগ্রহী শুনেছি।’
‘হ্যাঁ,’ বলল মালদিনি। ‘সিআইএ আর চাইনিজরাও। এত আগ্রহের কারণটা কি, মিস্টার রানা?’
‘তেইশটা মিসাইল।’
‘বাহ্ বেশ আলাপী লোক মনে হচ্ছে আপনি। আপনার ইসরাইলী বন্ধুটি কিন্তু মুখ খোলেনি।’
শব্দ করে হাসল রানা। ‘কার কাছে আছে ওগুলো অজানা নেই কারও। কেন আমাকে পাঠানো হয়েছে তাও বলছি, তার আগে বলুন তো ওগুলো জোগাড় করেছেন কেন? সঙ্গে তিনটে মিনিটম্যান যোগ করেছেন কি জন্যে?’
‘মিনিটম্যানগুলোর কথা বাদ দিন,’ দাবড়ি দিল মালদিনি। এক ঢোকে ওয়াইনটুকু নিঃশেষ করে আরেক গেলাস ঢালল, ‘প্রেস্টার জনের নাম শুনেছেন?’ জিজ্ঞেস করল।
‘কিংবদন্তীর সম্রাট। মধ্যযুগে ইথিওপিয়া শাসন করেছে।’
‘একটু ভুল করলেন। প্রেস্টার জন কিংবদন্তী নয়। সেবার রাণীও তাই। গাল-গল্প ফেঁদে ওরা অভিশপ্ত ইথিওপিয়ানদের বুঝিয়েছিল তারা আফ্রিকার সেরা জাতি। ওরা দেখবেন, বলে আনন্দ পায় আফ্রিকায় একমাত্র ইথিওপিয়াই কখনও ইউরোপীয় কলোনিতে পরিণত হয়নি। উনিশ শতকের শেষ ভাগে অবশ্য ব্রিটেন গণহত্যা চালায় এদের ওপর, এবং উনিশশো ত্রিশের দশকে ইতালিয়ানরা এদেশ শাসন করে, কিন্তু এরা বেমালুম ভুলে যায় ওসব অপ্রীতিকর ঘটনা। আরেকজন প্রেস্টার জনকে মুকুট পরাতে এক পায়ে খাড়া এরা।’
‘আপনাকে?’
‘আমাকে।’
‘বর্তমান ইথিওপিয়ান সরকার বাধা দেবে না?’
‘একান্ত বাধ্য না হলে ঝামেলায় জড়াবে না। তাছাড়া ডানাকিলে টহল দেয়া ওদের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই ওরাই হয়তো বিসিআইর মাধ্যমে আপনার সাহায্য চেয়েছে। এবং সেজন্যে এখানে দেখতে পাচ্ছি দুর্ধর্ষ এজেন্ট জনাব মাসুদ রানাকে। কেন জোগাড় করেছি মিসাইলগুলো জানতে চাইছিলেন না? শুনুন তবে, সহজ করেই বলি।’ একটুক্ষণ বিরতি নিল লোকটা। ‘পূর্ব আফ্রিকা শাসন করতে চাই আমি। প্রেস্টার জন কিংবদন্তী সাজতে
পেরেছিল তার কারণ, উত্তর-পুব আফ্রিকায় সে এক সুদক্ষ সৈন্য বাহিনী সমাবেশ করেছিল। এতে করে ইসলামের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়। আমার চারপাশে আছে আধুনিক দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা, অকুতোভয় সৈন্য ডানাকিলরা। ওদের দরকার শুধু একজন যোগ্য নেতা আর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র।’
‘মরুভূমিতে যারা হামলা করল তারাও তো ডানাকিল, ওরা চাইছিল আপনি যাতে মিনিটম্যান মিসাইলগুলো হাতে না পান।’
‘ওরা বিপথগামী,’ ক্রুদ্ধ স্বরে বলল লোকটা। ‘আর জেনে রাখবেন, ওই মিনিটম্যানগুলো কমপি−ট করা হবে। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ক’জন মিসাইল বিশেষজ্ঞ কাজ করছে আমার এখানে। রবার্তো মালদিনির নাম শিগ্গিরিই ছড়িয়ে পড়বে দুনিয়াময়।’ উন্মাদের মত চকচক করছে লোকটার চোখজোড়া। হঠাৎ আঙুল দাবাতে কোথাও বেল বেজে উঠল।
তাঁবুর ঢাকনা সরে যেতে এক আমহারিক যুবতী প্রবেশ করল ভেতরে। প্রায় ছ’ফুট লম্বা মেয়েটি, শরীর প্রদর্শনের জন্যেই পোশাক পরেছে যেন, মুখ থেকে বুক পর্যন্ত ঢাকা এক পাতলা কাপড়ে, এবং তার নিচে লম্বা এক স্কার্ট পরে রয়েছে।
‘এ হচ্ছে জুলেখা,’ বলল মালদিনি। ‘জুলেখা, আমাদের জন্যে আরেকটু ওয়াইন নিয়ে এসো।’
‘জ্বী, জেনারেল মালদিনি,’ চর্চাহীন ইতালিয়ান উচ্চারণে বলল যুবতী।
ও চলে যেতে বলল মালদিনি, ‘ওর বাবা আর চাচা কপটিক চার্চের নেতা। দরবারে প্রভাব আছে। ও যদ্দিন আমার জিম্মায়, ইথিওপিয়ানরা আমার বিরুদ্ধে একপা ফেলবে না।’
জুলেখা ফিরে এসে, রেড ওয়াইনের এক সদ্য মুখখোলা বোতল ধরিয়ে দিল মালদিনির হাতে। ‘ইনি মিস্টার রানা,’ পরিচয় করিয়ে দিল মালদিনি। ‘বলা যায়, গোটা দুনিয়ার তরফ থেকে ইথিওপিয়ায় এসেছেন।’
‘সত্যি?’ ইংরেজিতে শুধাল জুলেখা। মাথা ঝাঁকাল রানা।
‘ইতালিয়ান বলো!’ গর্জে উঠল আধপাগলা। পরমুহূর্তেই শান্ত স্বরে বলল, ‘মিস্টার রানা ক’দিনের জন্যে আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। বেঁচে থাকলে হয়তো আমাদের বিয়েটা দেখে যেতে পারবেন। তোমার বাবা কিংবা চাচা তোমাকে আমার হাতে যখন তুলে দেবে আরকি।’
‘কতবার বলব জান গেলেও একাজ করবে না তারা,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল যুবতী।
‘তোমাকে জ্যান্ত দেখতে চাইলে করবে।’
‘আমি ওদের কাছে অনেক আগেই মৃত।’
‘ওকথা বলে না, লক্ষ্মীটি,’ মিষ্টি করে বলল মালদিনি। ‘আর কিছু দিন পরেই আমি হব ইথিওপিয়ার জামাই, শাসন করব গোটা পূর্ব আফ্রিকা। তখন মেয়ে-জামাইয়ের গর্বে মাটিতে পা পড়বে না তোমার বাপ-চাচাদের।’ হাতের ঝটকায় এবার ওকে দূর করে
দিল মালদিনি। রানার উদ্দেশে বলল, ‘ক’দিন পর আবার কথা হবে আপনার সঙ্গে। আপাতত বন্দী হয়ে থাকুনগে যান।’
হাততালি দিল ও। ক্রীতদাস কম্পাউন্ডে রানাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে গেল দু’জন গার্ড।
ছোট্ট ডোবাটার পানিতে গাঁজলা। পাথুরে এক অবতলে, আশপাশে খুদে খুদে ঝোপ-ঝাড় নিয়ে অবস্থান ওটার। পানিতে ক্ষারের স্বাদ। চালকদের মরু-জ্ঞান বলছে এপানি খাওয়া চলে, রানার কাছে যদিও দুনিয়ার সবচাইতে সুস্বাদু-সুপেয় জল মনে হলো একে। অভিযানের প্র মার্ধে বেজায় হিসেব করে পানি দেয়া হয়েছিল ওদের, এবং শেষের তিনদিন পানির অভাবে ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেছে শরীর।
উটগুলো আকণ্ঠ পান করে তাজ্জব করে দিল রানাকে। ডোবার পানির স্তর এতই দ্রুত নামিয়ে দিল যে মনে হলো, কোন পাতালনদী ডোবার পানি শুষে নিচ্ছে বুঝি। আর কোন স্থলচর প্রাণী হলে এত পানি একসঙ্গে পান করে নির্ঘাত মারা পড়ত। কিন্তু এদের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সাধে কি আর মরুর জাহাজ বলে এদেরকে?
‘রাতে এখানে ক্যাম্প করব আমরা,’ রানাকে বলল সাচ্চি। ‘সকালে ডোবা ভর্তি হলে ক্যান্টিন ভরে নেব।’
‘আর কেউ পানি চাইলে তখন?’
হেসে উঠল সাচ্চি। ‘সিংহ?’
‘মানুষও হতে পারে।’
রাইফেলে চাপড় দিল সাচ্চি। ‘বেশি লোক এলে আবারও রাইফেল হাতে পাবে তুমি।’
সে রাতে দুটো অগিড়বকুণ্ড জ্বালা হলো। চালক, গার্ড ও বন্দীদের জন্যে একটা, আর অপরটা সাচ্চি ও তার পেয়ারের লোকেদের জন্যে। রানাকে আমন্ত্রণ জানাল লোকটা।
‘দু’দিনের মধ্যে মালদিনির কাছে পৌঁছচ্ছি আমরা,’ বলল।
‘কে মালদিনি?’
‘জানো না?’
‘গুজব শুনেছি শুধু।’
‘গুজব,’ আগুনে থুথু ফেলল সাচ্চি। ‘জেনারেল মালদিনি সম্পর্কে কাফেলার লোকজন ভুলভাল কথা বলে। অনেক বছর আগে, আমাদের গ্রামে আসে জেনারেল। আমরা মেরে ফেলতে পারতাম তাকে, কিন্তু আমাদের শহরবাসী কিছু গোত্রীয় লোক বন্ধুত্ব করতে বলে তার সাথে। জেনারেল মালদিনি প্রতিশ্রুতি দেয় তাকে সাহায্য করলে আমাদের সম্পদ আর ক্রিতদাস দেবে। কাজেই তাকে সাহায্য করি আমরা।’
‘সম্পদ পেয়েছ?’ জিজ্ঞেস করল রানা। জবাবে মাথা ঝাঁকিয়ে, হাতের দোলায় ক্যারাভান দেখাল সাচ্চি।
নারী কণ্ঠের আর্তনাদ শোনা গেল হঠাৎ অপর অগিড়বকুণ্ডটার কাছ থেকে। ঘনীভূত আঁধার ভেদ করে চোখ কুঁচকে চাইল রানা। তিন ক্রীতদাসীকে বাধ্য করা হচ্ছে কাপড় খুলতে, এবং কয়েকজন পুরুষকে দেখা গেল ওদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে। সাচ্চির দিকে
চাইল রানা। দৃষ্টিক্ষেপ করল না লোকটা।
‘ওরা ক্রীতদাসী,’ বলল সাচ্চি, ‘একাজের জন্যেই কেনা হয়েছে ওদের। জেনারেল মালদিনি বেশ কিছু সাদাচামড়ার মানুষ আমদানী করেছে। তাদের মেয়েমানুষ দরকার হয়। এরা মালদিনির সম্পত্তি।’
‘তোমার নিশ্চয় ভাল লাগে না এসব?’
‘যোদ্ধা ভালবাসে তার মেয়েমানুষ, অস্ত্র আর উট। আমার পূর্বপুরুষরা কবে থেকে এখানে বাস করে কেউ জানে না, আমরা জানি জেনারেল যত লোক নিয়ে এসেছে তাদের জায়গা এখানে হবে না। উত্তরের আমহারিক খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে সবসময় লড়ে নিজেদের আবাস ভূমি রক্ষা করতে হয় আমাদের। জেনারেল মালদিনির যে-সব লোকেরা আজব ওই অস্ত্র বানাচ্ছে তাদের সঙ্গে লাগতে চাই না আমরা। যাকগে, ম্যাকলিনের জাহাজে উঠেছিলে কেন তুমি?’
‘জেনারেল মালদিনির পরিচয় জানার জন্যে।’
‘জানবে।’ নীরস হাসি হাসল সাচ্চি। ‘আরও অনেকে জানতে চেয়েছে। কেউ কেউ জেনারেলের দলে যোগ দিয়েছে। বাকিরা মৃতদের দলে। আমি আশা করব তুমি তার সাথে যোগ দেবে।’
জবাব দিল না রানা। ‘কি, দেবে?’ প্রশ্ন করল সাচ্চি।
‘না, সাচ্চি,’ বলল রানা। ‘ওর প্ল্যান সম্পর্কে তোমার আশঙ্কায় ভুল নেই। শত্রুরা এক সময় না একসময় জেনারেলকে খুঁজে বের করে খতম করবেই করবে। সঙ্গে মারা পড়বে তাকে যারা সাহায্য করছে তারাও।’
‘আমার লোকদের কথা বলছ?’ জবাব চাইল সাচ্চি। মাথা নেড়ে সায় জানাল রানা।
আগুনে আরেক দলা থুথু ফেলল সাচ্চি। ‘আমার বাপের আমলে ইতালিয়ানরা এদেশে এসেছিল। পে−ন, বোমা, এসব ছাড়াও নানান আজব অস্ত্র ছিল তাদের কাছে। পাহাড়ে, আমহারিক খ্রিস্টানদের শাসন করেছে তারা। আমাদের দক্ষিণে, গালা শাসন করেছে। কিন্তু অ্যাফার, মানে আমাদের লোকেরা যুদ্ধ করেছে। মরুভূমিতে এসে মরেছে ওরা। এটা ধ্রুব সত্য। বিদেশী লোক যখনই ডানাকিলে অনুপ্রবেশ করেছে, মারা পড়েছে।’
একটু পরে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে রানাকে বিদেয় করল সাচ্চি। অন্যান্য পুরুষ ক্রীতদাসদের কাছে, নিজের জন্যে বরাদ্দ জায়গায় চলে এল ও।
সে রাতে তিনবার ঘুম ভাঙল রানার। একবার ক্রীতদাসী দু’জনের চিৎকারে, আরেকবার এক সিংহের গর্জনে। তৃতীয়বার ভাঙল কোন কারণ ছাড়াই। প্রতিবারই, সজাগ ছিল সাচ্চি।
মালদিনির প্রকাণ্ড তাঁবুতে ক্রীতদাসদের জন্যে চারটে কম্পাউন্ড, ঘেরা তিনটে ও অন্যটা মহিলাদের। কাঁটাতারের বেড়া দেয়া নিচু, পাথুরে পাহাড়ের উপত্যকায় তৈরি করা হয়েছে ওগুলো। নেতাদের অর্থাৎ স্বাধীন মানুষদের জন্যে তাঁবু খাটানো হয়েছে ঝোপগুচ্ছ ও ঝর্নার ধার ঘেঁষে। রাস্তাটা চিনে নেয়ার সুযোগ পেল না রানা। একদল ডানাকিল দৌড়ে এসে ক্যারাভান ঘিরে ফেলল। সাচ্চির সঙ্গে কথাবার্তা বলছে।
ওদের ভাষা রানার অজানা। কিন্তু সাচ্চির দেহভঙ্গি ও রানার উদ্দেশে চকিত চাহনি বলে দিল যুদ্ধের বর্ণনা দিচ্ছে সে। গার্ডদের একটা গ্রুপ রানাকে দ্রুত এক ক্রীতদাস কম্পাউন্ডের দিকে সরিয়ে নিয়ে গেল। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে আদেশ করল।
‘তুমি নিশ্চয়ই সেই আমেরিকান,’ বলে উঠল এক ব্রিটিশ কণ্ঠ, ডান পাশ থেকে।
ঘুরে দাঁড়াল রানা। খোঁড়া এক লোক ক্রাচে ভর দিয়ে এগিয়ে এল। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিচয় পর্ব সারা হলে জানা গেল লোকটার নাম টনি গ্রেগ।
‘তুমি নাকি বিসিআই না কিসের স্পাই শুনলাম। তোমার সাথের মহিলাটি কোথায়?’
রানা কাফেলা আক্রমণের বৃত্তান্ত জানাল।
‘রক্ত পিপাসু, ওই ডানাকিল শালারা,’ বলল লোকটা। ‘পাঁচ বছর আগে ওদের হাতে ধরা পড়ি আমি। ইথিওপিয়ান আর্মি পেট্রলের উপদেষ্টা ছিলাম, ঠোকাঠুকি বাধে মালদিনির ছেলেদের সাথে। পা-টা তখনই খোয়াই। একমাত্র আমিই বেঁচে আছি, আমাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে আর কি, আমাকে দিয়ে ফুট-ফরমাশ খাটিয়ে বোধহয় আমোদ পায় মালদিনি।’
ওর প্রতি সহানুভূতি অনুভব করল রানা। ‘স্পাই, একথা আমি স্বীকার করছি,’ বলল। ‘মালদিনির মতলবটা কি শিয়োর হতে পাঠানো হয়েছে আমাকে।’
‘পুরো দুনিয়াটা দখল করে নেবে,’ সশব্দে হেসে উঠল টনি গ্রেগ। ‘শিগ্গিরই বলবে তোমাকে এসব কথা। তা, ধরা পড়লে কিভাবে?’
জাহাজে কভার ফাঁস হয়ে যাওয়ার কাহিনী শোনাল রানা। জানাল, বিপদটা শুরু হয় জিওনিস্টের এজেন্টটিকে মারধর করে সাগরে ফেলে দেয়ার পর থেকে।
‘ইসরাইল এসবের সাথে জড়িত নয়, মিস্টার রানা,’ বলল টনি। ‘এজায়গাটার কথা জানতে পারলে তোমার দেশের মত ওরাও এটাকে নিশ্চিম করতে দ্বিধা করবে না। ক’সপ্তাহ আগে এক ইসরাইলী স্পাই ছিল এখানে, সে-ই তো খেপিয়ে তুলল জেনারেল
মালদিনিকে।’
টনির সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কম্পাউন্ড দেখল রানা। পরিচিত হলো ক’জন আমহারিক ও সবকজন বন্দীর সঙ্গে-দু’জন জার্মান, এক সুইড, আর রাহাত খানের পরিচিত সেই কুদরত চৌধুরী। ভদ্রলোককে চেনে এমন ভাব দেখাল না ও। এরা সবাই ডানাকিলে
এসেছিল মালদিনি ওদের চাকরি দেবে ভেবে, কিন্তু ক্রীতদাস হয়ে পচে মরছে।
‘খুব ভাল লোক মনে হচ্ছে,’ টনিকে বলল রানা।
‘সত্যিই তাই, যদি ষড়যন্ত্র না করে অনুগত থাকতে পারো।’
ডিনারের পর, মালদিনির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেল রানা। পূর্বধারণা ইচ্ছে করেই উপেক্ষা করেছে ও। একমাত্র যে ছবিটা ও দেখেছিল, কয়েক বছর আগে তোলা, তাতে কঠোর চেহারার, কোটরাগত চক্ষু একজন রাজনীতিকের সাক্ষ্য মেলে। রোদে থাকতে থাকতে গায়ের রং তামাটে হয়ে গেছে এখন ওর, এবং চোখজোড়া যেন নিশ্চ্রাণ প্রায়।
দু’জন গার্ড রানাকে নিয়ে এলো তার সামনে।
‘বসুন, মিস্টার রানা,’ আমন্ত্রণ জানাল মালদিনি। নিচু টেবিলটার এপাশে মুখোমুখি বসল রানা। রাইফেলধারী গার্ড দু’জনকে বিদেয় করে দিয়ে একই সঙ্গে কোমর থেকে পিস্তলটা
বের করে হাতের নাগালের মধ্যে রাখল লোকটা।
‘সাচ্চির মুখে জানতে পারলাম, আপনার কারণেই নাকি শেষ কাফেলাটা এসে পৌঁছুতে পেরেছে,’ বলল মালদিনি। ‘সেদিক দিয়ে আমি হয়তো আপনার কাছে ঋণী।’
‘আমি নিজের জীবন বাঁচিয়েছি,’ বলল রানা। ‘ওই ডাকাতগুলো আমাকে মুক্ত করতে আসেনি।’
‘খাঁটি সত্যি কথা। ওয়াইন?’
‘ধন্যবাদ,’ বলল রানা। বাঁ হাতে গেলাসে তরল ঢেলে, মালদিনিকে ওর দিকে সাবধানে ঠেলে দিতে দেখে সতর্কতার মাত্রাটা বুঝল। লাল পানীয় ছলকে পড়ে যাওয়ার দশা, এতটাই গভীর মনোযোগে রানাকে লক্ষ করছিল লোকটা।
‘ম্যাকলিন বলছিল আপনি নাকি খুব ডেঞ্জারাস লোক, যদিও বারে বারে বলেছে, রেডিও অপারেটরকে আপনি মারধর করেননি। মেয়েটাও কিছু বলেনি। হয়তো ঘুমের ঘোরে টলে পড়ে ব্যথা পেয়েছে। যাকগে, এখানে এলেন কেন?’
‘ইথিওপিয়ান সরকার আমাদের সাহায্য চেয়েছে।’
‘কেজিবির বা জিওনিস্টের সাথে কাজ করছেন?’
‘না, কিন্তু তারাও আপনার প্রতি আগ্রহী শুনেছি।’
‘হ্যাঁ,’ বলল মালদিনি। ‘সিআইএ আর চাইনিজরাও। এত আগ্রহের কারণটা কি, মিস্টার রানা?’
‘তেইশটা মিসাইল।’
‘বাহ্ বেশ আলাপী লোক মনে হচ্ছে আপনি। আপনার ইসরাইলী বন্ধুটি কিন্তু মুখ খোলেনি।’
শব্দ করে হাসল রানা। ‘কার কাছে আছে ওগুলো অজানা নেই কারও। কেন আমাকে পাঠানো হয়েছে তাও বলছি, তার আগে বলুন তো ওগুলো জোগাড় করেছেন কেন? সঙ্গে তিনটে মিনিটম্যান যোগ করেছেন কি জন্যে?’
‘মিনিটম্যানগুলোর কথা বাদ দিন,’ দাবড়ি দিল মালদিনি। এক ঢোকে ওয়াইনটুকু নিঃশেষ করে আরেক গেলাস ঢালল, ‘প্রেস্টার জনের নাম শুনেছেন?’ জিজ্ঞেস করল।
‘কিংবদন্তীর সম্রাট। মধ্যযুগে ইথিওপিয়া শাসন করেছে।’
‘একটু ভুল করলেন। প্রেস্টার জন কিংবদন্তী নয়। সেবার রাণীও তাই। গাল-গল্প ফেঁদে ওরা অভিশপ্ত ইথিওপিয়ানদের বুঝিয়েছিল তারা আফ্রিকার সেরা জাতি। ওরা দেখবেন, বলে আনন্দ পায় আফ্রিকায় একমাত্র ইথিওপিয়াই কখনও ইউরোপীয় কলোনিতে পরিণত হয়নি। উনিশ শতকের শেষ ভাগে অবশ্য ব্রিটেন গণহত্যা চালায় এদের ওপর, এবং উনিশশো ত্রিশের দশকে ইতালিয়ানরা এদেশ শাসন করে, কিন্তু এরা বেমালুম ভুলে যায় ওসব অপ্রীতিকর ঘটনা। আরেকজন প্রেস্টার জনকে মুকুট পরাতে এক পায়ে খাড়া এরা।’
‘আপনাকে?’
‘আমাকে।’
‘বর্তমান ইথিওপিয়ান সরকার বাধা দেবে না?’
‘একান্ত বাধ্য না হলে ঝামেলায় জড়াবে না। তাছাড়া ডানাকিলে টহল দেয়া ওদের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই ওরাই হয়তো বিসিআইর মাধ্যমে আপনার সাহায্য চেয়েছে। এবং সেজন্যে এখানে দেখতে পাচ্ছি দুর্ধর্ষ এজেন্ট জনাব মাসুদ রানাকে। কেন জোগাড় করেছি মিসাইলগুলো জানতে চাইছিলেন না? শুনুন তবে, সহজ করেই বলি।’ একটুক্ষণ বিরতি নিল লোকটা। ‘পূর্ব আফ্রিকা শাসন করতে চাই আমি। প্রেস্টার জন কিংবদন্তী সাজতে
পেরেছিল তার কারণ, উত্তর-পুব আফ্রিকায় সে এক সুদক্ষ সৈন্য বাহিনী সমাবেশ করেছিল। এতে করে ইসলামের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়। আমার চারপাশে আছে আধুনিক দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা, অকুতোভয় সৈন্য ডানাকিলরা। ওদের দরকার শুধু একজন যোগ্য নেতা আর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র।’
‘মরুভূমিতে যারা হামলা করল তারাও তো ডানাকিল, ওরা চাইছিল আপনি যাতে মিনিটম্যান মিসাইলগুলো হাতে না পান।’
‘ওরা বিপথগামী,’ ক্রুদ্ধ স্বরে বলল লোকটা। ‘আর জেনে রাখবেন, ওই মিনিটম্যানগুলো কমপি−ট করা হবে। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ক’জন মিসাইল বিশেষজ্ঞ কাজ করছে আমার এখানে। রবার্তো মালদিনির নাম শিগ্গিরিই ছড়িয়ে পড়বে দুনিয়াময়।’ উন্মাদের মত চকচক করছে লোকটার চোখজোড়া। হঠাৎ আঙুল দাবাতে কোথাও বেল বেজে উঠল।
তাঁবুর ঢাকনা সরে যেতে এক আমহারিক যুবতী প্রবেশ করল ভেতরে। প্রায় ছ’ফুট লম্বা মেয়েটি, শরীর প্রদর্শনের জন্যেই পোশাক পরেছে যেন, মুখ থেকে বুক পর্যন্ত ঢাকা এক পাতলা কাপড়ে, এবং তার নিচে লম্বা এক স্কার্ট পরে রয়েছে।
‘এ হচ্ছে জুলেখা,’ বলল মালদিনি। ‘জুলেখা, আমাদের জন্যে আরেকটু ওয়াইন নিয়ে এসো।’
‘জ্বী, জেনারেল মালদিনি,’ চর্চাহীন ইতালিয়ান উচ্চারণে বলল যুবতী।
ও চলে যেতে বলল মালদিনি, ‘ওর বাবা আর চাচা কপটিক চার্চের নেতা। দরবারে প্রভাব আছে। ও যদ্দিন আমার জিম্মায়, ইথিওপিয়ানরা আমার বিরুদ্ধে একপা ফেলবে না।’
জুলেখা ফিরে এসে, রেড ওয়াইনের এক সদ্য মুখখোলা বোতল ধরিয়ে দিল মালদিনির হাতে। ‘ইনি মিস্টার রানা,’ পরিচয় করিয়ে দিল মালদিনি। ‘বলা যায়, গোটা দুনিয়ার তরফ থেকে ইথিওপিয়ায় এসেছেন।’
‘সত্যি?’ ইংরেজিতে শুধাল জুলেখা। মাথা ঝাঁকাল রানা।
‘ইতালিয়ান বলো!’ গর্জে উঠল আধপাগলা। পরমুহূর্তেই শান্ত স্বরে বলল, ‘মিস্টার রানা ক’দিনের জন্যে আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। বেঁচে থাকলে হয়তো আমাদের বিয়েটা দেখে যেতে পারবেন। তোমার বাবা কিংবা চাচা তোমাকে আমার হাতে যখন তুলে দেবে আরকি।’
‘কতবার বলব জান গেলেও একাজ করবে না তারা,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল যুবতী।
‘তোমাকে জ্যান্ত দেখতে চাইলে করবে।’
‘আমি ওদের কাছে অনেক আগেই মৃত।’
‘ওকথা বলে না, লক্ষ্মীটি,’ মিষ্টি করে বলল মালদিনি। ‘আর কিছু দিন পরেই আমি হব ইথিওপিয়ার জামাই, শাসন করব গোটা পূর্ব আফ্রিকা। তখন মেয়ে-জামাইয়ের গর্বে মাটিতে পা পড়বে না তোমার বাপ-চাচাদের।’ হাতের ঝটকায় এবার ওকে দূর করে
দিল মালদিনি। রানার উদ্দেশে বলল, ‘ক’দিন পর আবার কথা হবে আপনার সঙ্গে। আপাতত বন্দী হয়ে থাকুনগে যান।’
হাততালি দিল ও। ক্রীতদাস কম্পাউন্ডে রানাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে গেল দু’জন গার্ড।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।