
কাগা এসে মা’কে জিগ্যেস করল, “মা, সত্যি?” “দূর বোকা! যদি জানতাম ওটা কোকিলের ডিম তবে তা-ই দিতাম না।” “তাহলে আমি কেন গাইতে পারি না? কোকিল পারে।” “চেষ্টা কর, তুইও পারবি। বগার কাছে শেখ।”
কাগা এসে ফের বগাকে ধরল, “না বগাদা, আমি শিখব, তুমি শেখাও।” বগা একটু ভেবে বলল, “বেশ, এখুনি শুরু কর। বল দেখি – সা।” কাগা বলল, “কা।” “বল – রে।” কাগা বলল, “কে।” “ঠিক আছে। এবার পুরোটা বল – সারে গামা পাধা নি।” কাগা বলল, “কাকে কাকা কাখা কি।” “আচ্ছা, বল দেখি – ডো রে মি ফা সো লা টি।” “কোকে কিখা কোকা কি।”
বগা খুব গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ পেট-টেট চুলকে বলল, “বুঝলি কাগা, তোর যে হবে না তা নয়। হবে। তবে তোর জন্য স্পেশাল গান লিখতে হবে।” “লেখো না বগাদা, লিখে দাও। কোকিলের খুব দেমাক হয়েছে। একসঙ্গে ডিম ফুটে তো বেরিয়েছি, অত দেমাকের কী আছে? ওকে দেখিয়ে দেব আমিও গাইতে পারি।” “কোকিলের মত তুই গাইতে পারবি না। তা, সে তার দেমাক নিয়ে থাক না, তোর তাতে কী? তুই তোর মত গাইবি।” “ঠিক আছে, তাই সই। যা পারি গাইব। তুমি লিখে দাও। আমাদের বাসার পাশের বটগাছে আমার কাকা-কাকিমা থাকেন। সামনের রোববার তাঁদের যমজ মেয়ে কাকলি- কাঁকনের ঠোঁটেভাত। কোকিল সেখানে গাইতে আসবে। আমিও গাইব। তোমারও তো নেমন্তন্ন আছে।” “বেশ, আজ আমি লিখে রাখছি। কাল সকালে আসিস, শিখিয়ে দেব।”
পরদিন ভোর হতে না হতে কাগা বিলের ধারে হাজির, “বগাদা, লিখেছ?” “হুম, লিখলাম। তবে তুই একা পুরোটা গাইতে পারবি কি না জানি না। আমি গাইছি, আমার সঙ্গে কর।” তারপর দু’জনে মিলে খুব ক’দিন রিহার্সাল চলল। বগা যত বলে “ওরে কাগা, আজ এখানেই থাক”; কাগা নাছোড়বান্দা, “বগাদা, আরেকবার।”
রোববার দিন বটগাছে এলাহি আয়োজন, হুলুস্থুলু কাণ্ড। সমস্ত পাখপাখালির নিমন্ত্রণ। কাঁকুড়গাছি, কাকদ্বীপ, কাকিনাড়া, কাকরভিটা থেকে কাগাদের সমস্ত আত্মীয়স্বজন এসেছে। সকালে কেক, কুকিজ আর কোকাকোলা দিয়ে ব্রেকফাস্ট, দুপুরে কাঁকরোল ভাজা আর কাঁকড়ার ঝোল দিয়ে ভরপেট লাঞ্চ।
খেয়েদেয়ে পেট ফুলিয়ে কোকিল একবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “এবার একটু গানবাজনা করলে হয় না? আমার গলাটা যদিও খুব একটা ভাল নেই –” সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত পাখি একসাথে বলে উঠল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, হোক হোক, গান হোক, গান হোক।” আরেকবার গলা খাঁকারি দিয়ে কোকিল খুব শক্ত একটা নজরুলগীতি ধরল, “কুহু কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া, কুহরিল মহুয়াবনে –”
গান শেষ হতে পাখিরা ডানা ঝাপটিয়ে খুব ডানা-তালি দিল, “হোক হোক, আরও হোক।” কাগা বলল, “এবার আমি গাইব।” সবাই তো অবাক। “কাগা, তুই? তুই গান গাইবি? তা হয়ে যাক, হয়ে যাক।”
কোকিল পরের গানটা ধরতে যাচ্ছিল, বাধা পড়ায় বিরক্ত হয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, “তুই আবার কী গান গাইবি কাগা? সারেগামাই জানিস না!” কাগা ঘাড় শক্ত করে বলল, “তোর মত আমি গাইতে পারব না ঠিকই, মেনে নিলাম। তবে আমি যা গাইব, তুইও তা গাইতে পারবি না। চ্যালেঞ্জ।” কোকিল খ্যা খ্যা করে হেসে উঠে বলল, “চ্যালেঞ্জ! হাসালি। তুই আর কী গান করবি! যে কোনও গান আমি একবার শুনেই গাইতে পারি।”
এমন সময় বগা বলল, “তা, কোকিলের গান তো আমরা রোজই শুনি। আজ কাগার বাড়ি এলাম, ভালমন্দ খেলাম, না হয় কাগার গানই শুনলাম একটা। আমাদের তো একটা কৃতজ্ঞতা আছে, না কি? কী বল সবাই? কাগা তুই গা। আমিও গলা মেলাব, ধুয়ো ধরব।” এই বলে কাগাকে আড়ালে একবার চোখ টিপে দিল। অমনি সব কাকপক্ষী বেজায় সোরগোল তুলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক ঠিক। এবার কাগা গাইবে। সঙ্গে বগাও গাইবে। সেটা শুনে কোকিল গাইতে পারে কি না দেখা যাবে। কাগা শুরু কর।”
কাগা তো তৈরিই ছিল। বগার সঙ্গে ডুয়েটে শুরু হল তার স্পেশাল গান –
কাগাবগা। | কাকেরা কা কা করে কেকীতে কেকা ডাকে ‘কোঁকর কো কো’ রবে কাননে কাকাতুয়া | কাকে কে ডেকে যায় কোকিলে কূ কূ গায়। কুঁকড়ো ডাকে ভোরে কলকাকলি করে। |
বগা। | কাকা কাকিমা কাগা কাঁকড়া কাঁকরোলে | কাঁকন ও কাকলি কী খাওয়া খাওয়ালি।। |
কাগাবগা। | কোকাকোলা কি কোকো কুকিজে নাকি কেকে কাকেবকেতে মিলি ককবরক বলি | কাকু-কাকি কী খায়? খোকন-খুকু ভুলায়? কত কী কথকতা বোঝ কি বোঝ না তা? |
বগা। | কাকা কাকিমা কাগা কাঁকড়া কাঁকরোলে | কাঁকন ও কাকলি কী খাওয়া খাওয়ালি।। |
গান শেষ হতেই পাখিদের তুমুল ডানা-তালি, “দারুণ, দারুণ। পুরো জমে গেছে।” উপস্থিত কাকেরা বলল, “এটাকে কাকেদের জাতীয় সঙ্গীত করা হোক। ইমিডিয়েট।”
সবাই কোকিলের দিকে ফিরে বলল, “কই, এবার তোমার পালা। গাও দিকিনি এটা!” কোকিল তো “হুঁহ, এ আর এমন কী” বলে খুব শুরু করল, কিন্তু দু’লাইন গাইতে না গাইতেই ঠোঁটে-ঠোঁটে জড়িয়ে গিয়ে এমন কাণ্ড বাধাল যে তার গলা দিয়ে আর স্বরই বেরোয় না। সমবেত কাকেদের কা কা খা খা দুয়ো শুনে সে উড়ে পালাল।
শোনা যায়, কোকিলের ঠোঁটদুটো নাকি এমনই পাকিয়ে গেছিল যে পরদিন কাঠঠোকরাকে ডেকে ঠুকরে ঠুকরে সে দুটো ফের আলাদা করতে হয়েছিল, নইলে ফি বসন্তে তার কুহু কুহু গান গাওয়া বেরিয়ে গেছিল আর কি!