সকাল থেকেই অঙ্কে মন বসছিল না টুকানের। বাইরে অবিরাম ভোকাট্টার ফোয়ারা ছুটছে, এই সময়ে অ্যালজেব্রা
কষতে কারুর ভালো লাগে? ধুৎতেরি বলে বইখাতা ফেলে উঠেই পড়ল টুকান। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখল, মা কড়াইতে কী একটা চাপিয়ে খুন্তি দিয়ে নাড়ছেন। আহা, এই তো সুযোগ । এবার পা টিপে টিপে সরে পড়লেই তো হয়।
যা ভাবা, তাই কাজ। চুপিসাড়ে সিঁড়ি টপকে টুকান সোজা ছাদে। খোলা আকাশের নীচে এসে প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল।
নীল চাদোয়ার গায়ে কত যে রংবেরঙি ঘুড়ির মেলা। চৌখুপ্পি, পেটকাট্টি, জয়হিন্দ, চাঁদিয়াল, গঙ্গাযমুনা…। সবকটা ঘুড়িকে নামে নামে চেনে টুকান। এক-একটা ঘুড়ি বাড়তে বাড়তে কোথায় যে চলে গেছে! ফুটকির মতো দেখাচ্ছে। যেন এক খুদে সম্রাট, হেলা ভরে অবলোকন করছে পৃথিবীকে। যে ঘুড়িগুলো কাছাকাছি, তাদের মধ্যে প্যাঁচ চলছে জোর। ওই তো একটা পেটকাট্টি একখানা জয়হিন্দুকে কুচুৎ কেটে দিল।
অমনি বুম্বাদের ছাদে বিকট উল্লাসধ্বনি—-ভোম্মারা!
আওয়াজটা শুনে মনটা কেমন স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেল টুকানের। বন্ধুদের কত জপিয়ে-জাপিয়ে সুতোয় মাঞ্জা দেওয়ার কলাকৌশল রপ্ত করেছে সে। কত গ্রাম কাচগুড়োর সঙ্গে ক’চামচ মাড় মেশালে সূতো তলোয়ারের মতো ধারালো হয়, টুকানের এখন মুখস্থ। এমনকী ডিম গুলে মাঞ্জা দিলে কটা দিন সুতো যে ইস্পাতের ছুরিকেও হার মানায়, তাও কি টুকানের অজানা! টানামাঞ্জা, লাটামাঞ্জার সূক্ষ্ম প্রভেদটাও সে রনিকে কত তেল মেরে মেরে শিখল। লাটামাঞ্জায় লাগে মিহি কাচের গুঁড়ো। কিন্তু টানা মাঞ্জার দটো চারটে ছোটবড় টুকরো থাকলে ক্ষতি নেই। তা এত শিক্ষালাভ, এইসব তথ্য আহরণ, সবই তো বৃথা। টুকনের মা টুকানকে লাটাই-ঘুড়ি ছুতেই দেন না। ঘুড়ি ওড়ালে নাকি মনটাও হাওয়ায় উড়বে, এবং তাতে নাকি পড়াশোনার বারোটা! কী কষ্ট করেই না টিফিনের পয়সা বঁচিয়ে বাঁচিয়ে টুকান একটা লাটাই কিনেছিল, মা’র হাতে পড়ে সেটা নিমেষে দুটুকরো! নিষ্ঠুর, মা বড্ড নিষ্ঠুর।
অগত্যা কী আর করা। উদাস চোখে চাঁদিয়ালের গোৎ খাওয়াই দেখছে টুকান। বুকের ভেতর দুঃখী বাতাস বইছে হুহু।
ঠিক তখনই কানের পাশে বিটকেল ডাক, কি ? টুকান চমকে তাকাল। কার্নিশে একটা কাক। ঘাড় বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে টুকানকেই নিরীক্ষণ করছে।
গোমড়া মুখে টুকান বলল, কী চাই?
কাক বলল, ‘কক্খ’।
টুকান আরও বিরক্ত হয়ে বলল, যা তো। ভাগ তো এখান থেকে ’
কাকটা কি টুকনের কথা বুঝতে পারল? উড়ে পালাল না অবশ্য, তবে পিছিয়েছে দু-তিন পা। জোড়া ঠ্যাঙে, লাফিয়ে লাফিয়ে। ফের ডাক ছাড়ল, “কক্ ক্ক।’
টুকান হঠাৎই খেয়াল করল, ধ্বনিগুলো প্রত্যেকটাই কেমন আলাদা আলাদা। প্রথমে ক, তার পরে কক, তারপর কক্ ক্ক! কাকদের নিজস্ব কোনও ভাষা আছে নাকি?
পরখ করার জন্য টুকান বলল, ‘যেতে বলছি না তোকে?
তুরন্ত জবাব, ‘ককা। ‘
এবার কিন্তু আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। অবাধ্যতা আমি একদম পছন্দ করি না।’
দু-সেকেন্ড নীরব থেকে কাক উত্তর ছুড়ল, “কা কক্।
হাঁ, টুকনের ধারণাই সঠিক। নিজস্ব ভাষাতেই টুকানের সঙ্গে কথোপকথন চালাচ্ছেন বায়সমশাই। মজা পেল টুকান। ভাষাটা শেখার চেষ্টা করলে কেমন হয় ? কিন্তু তার জন্য তো টানা সংলাপ দরকার।
ঘুড়ি ভুলে টুকান কাককে নিয়ে পড়ল। চোখ নাচিয়ে বলল, ‘তুই এখানে এসেছিস কেন বল তো?”
“খা”
খাবার-টাবারের ধান্দায় ঘুরছিস বুঝি ?’
‘কক্ কক্ কক্।’
“তো এখানে কেন? রাস্তায় যা ?
‘কা কা কক।
‘রাস্তায় কিছু জুটছে না? তাহলে দোতলায় গিয়ে দ্যাখ।
‘কা কা কক।
আরে বাবা, আছে আছে। মা জানলায় জোয়ান শুকোতে দিয়েছে।’
“কা কা কা কা।’
ঝাল লেগেছে বুঝি? টেস্ট করে দেখেছিস?’
‘খক।
অর্থাৎ হ্যা। টুকান চোখ পিটপিট করল। সে তো চমৎকার কাকের কথা বুঝতে পারছে! কাকেরও বলিহারি যাই, দিব্যি একটা ভাষা বানিয়ে ফেলেছে! দুটো মাত্র অক্ষরকে খেলিয়ে খেলিয়ে কেমন সুন্দর প্রকাশ করছে মনোভাব!
কৌতুহলী মুখে টাকান জিগ্যেস করল, ‘তোরা নিজেদের মধ্যে এভাবেই বাতচিৎ করিস নাকি রে?”
‘কা ক ?
অর্থাৎ তোমাকে বলব কেন?
‘আহা, শুনিই না।’
‘কা কক। কা কক্। বলেই কাকবাবু ডানা মেলে ধাঁ। মিনিটখানেক পর ফিরেছে এক সঙ্গীকে নিয়ে। দু-নম্বরটা ঘাড় নাচিয়ে নাচিয়ে দেখল টুকানকে। তারপর এক নম্বরকে বলল, “কা কা কাখক? এই ছেলেটার কথা বলছিলি বুঝি?
‘খক্! হাঁ।’
ককক্ ককক্ খক্ ? ব্যাটা ঢিল-টিল ছেড়ে না তো?”
কাক কাক। খা খা। না না, অনেকক্ষণ তো সামনে ছিলাম।
‘খাখাখা কক্। এমন ছেলে তো বড় একটা দেখা যায় না!
কাকক্ কখা। খা খা। কক্ কক্ কা। এও খুব সুবিধের নয়। তবে আজ এর খুব মন খারাপ।
ক্কা। কেন?
দুই কাকের আলাপচারিতা টুকনের কাছে এখন জলবৎ তরলং। যেন তার কানে কেউ কাকধ্বনি বোঝার যন্ত্র লাগিয়ে দিয়েছে।
শেষ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।