সতীশ। বড়োসাহেব হিসাবের খাতাপত্র কাল দেখবেন। মনে করেছিলেম, ইতিমধ্যে ‘গাণি’র টাকাটা নিশ্চয় পাওয়া যাবে, তহবিল পূরণ করে রাখব— কিন্তু বাজার নেমে গেল। এখন জেল ছাড়া গতি নেই। ছেলেবেলা হতে সেখানে যাবারই আয়োজন করা গেছে।
কিন্তু, অদৃষ্টকে ফাঁকি দেব। এই পিস্তলে দুটি গুলি পুরেছি — এই যথেষ্ট। নেলি— না না, ও নাম নয়, ও নাম নয়— আমি তা হলে মরতে পারব না। যদি-বা সে আমাকে ভালোবেসে থাকে, সে ভালোবাসা আমি ধুলিসাৎ করে দিয়ে এসেছি। চিঠিতে আমি তার কাছে সমস্তই কবুল করে লিখেছি। এখন পৃথিবীতে আমার কপালে যার ভালোবাসা বাকি রইল সে আমার এই পিস্তল। আমার অন্তিমের প্রেয়সী, ললাটে তোমার চুম্বন নিয়ে চক্ষু মুদব।
মেসোমশায়ের এ বাগানটি আমারই তৈরি । যেখানে যত দুর্লভ গাছ পাওয়া যায় সব সংগ্রহ করে এনেছিলেম। ভেবেছিলেম, এ বাগান একদিন আমারই হবে। ভাগ্য কার জন্য আমাকে দিয়ে এই গাছগুলো রোপণ করে নিচ্ছিল তা আমাকে তখন বলে নি— তা হোক, এই ঝিলের ধারে এই বিলাতি স্টিফানোটিস লতার কুঞ্জে আমার এ জন্মের হাওয়া খাওয়া শেষ করব— মৃত্যুর দ্বারা আমি এ বাগান দখল করে নেব— এখানে হাওয়া খেতে আসতে আর কেউ সাহস করবে না।
মেসোমশায়কে প্রণাম করে পায়ের ধুলো নিতে চাই । পৃথিবী হতে ঐ ধুলোটুকু নিয়ে যেতে পারলে আমার মৃত্যু সার্থক হত। কিন্তু, এখন সন্ধ্যার সময় তিনি মাসিমার কাছে আছেন— আমার এ অবস্থায় মাসিমার সঙ্গে দেখা করতে আমি সাহস করি নে। বিশেষত পিস্তল ভরা আছে।
মরবার সময় সকলকে ক্ষমা করে শান্তিতে মরার উপদেশ শাস্ত্রে আছে। কিন্তু, আমি ক্ষমা করতে পারলেম না। আমার এ মরবার সময় নয়। আমার অনেক সুখের কল্পনা, ভোগের আশা ছিল— অল্প কয়েক বৎসরের জীবনে তা একে একে সমস্তই টুকরা টুকরা হয়ে ভেঙেছে। আমার চেয়ে অনেক অযোগ্য, অনেক নির্বোধ লোকের ভাগ্যে অনেক অযাচিত সুখ জুটেছে, আমার জুটেও জুটল না— সেজন্য যারা দায়ী তাদের কিছুতেই ক্ষমা করতে পারব না— কিছুতেই না। আমার মৃত্যুকালের অভিশাপ যেন চিরজীবন তাদের পিছনে পিছনে ফেরে— তাদের সকল সুখকে কানা করে দেয়। তাদের তৃষ্ণার জলকে বাষ্প করে দেবার জন্য আমার দগ্ধ জীবনের সমস্ত দাহকে যেন আমি রেখে যেতে পারি।
হায়! প্রলাপ! সমস্তই প্রলাপ! অভিশাপের কোনো বলই নেই। আমার মৃত্যু কেবল আমাকেই শেষ করে দেবে— আর কারও গায়ে হাত দিতে পারবে না। আঃ— তারা আমার জীবনটাকে একেবারে ছারখার করে দিলে, আর আমি মরেও তাদের কিছুই করতে পারলেম না। তাদের কোনো ক্ষতি হবে না— তারা সুখে থাকবে,তাদের দাঁতমাজা হতে আরম্ভ করে মশারি-ঝাড়া পর্যন্ত কোনো তুচ্ছ কাজটিও বন্ধ থাকবে না— অথচ আমার সূর্য-চন্দ্র-নক্ষত্রের সমস্ত আলোক এক ফুৎকারে নিবল— আমার নেলি— উঃ, ও নাম নয়।
ও কে ও! হরেন! সন্ধ্যার সময় বাগানে বার হয়েছে যে! বাপ-মাকে লুকিয়ে চুরি করে কাঁচা পেয়ারা পাড়তে এসেছে। ওর আকাঙ্ক্ষা ঐ কাঁচা পেয়ারার চেয়ে আর অধিক ঊর্ধ্বে চড়ে নি— ঐ গাছের নিচু ডালেই ওর অধিকাংশ সুখ ফলে আছে। পৃথিবীতে ওর জীবনের কী মূল্য। গাছের একটা কাঁচা পেয়ারা যেমন, এ সংসারে ওর কাঁচা জীবনটাই বা তার চেয়ে কী এমন বড়ো। এখনই যদি ছিন্ন করা যায় তবে জীবনের কত নৈরাশ্য হতে ওকে বাঁচানো যায় তা কে বলতে পারে। আর মাসিমা— ইঃ! একেবারে লুটাপুটি করতে থাকবে। আঃ!
ঠিক সময়টি, ঠিক স্থানটি, ঠিক লোকটি। হাতকে আর সামলাতে পাচ্ছি নে। হাতটাকে নিয়ে কী করি। হাতটাকে নিয়ে কি করা যায়।
ছড়ি লইয়া সতীশ সবেগে চারাগাছগুলিকে ক্রমাগত আঘাত করিতে লাগিল। তাহাতে তাহার উত্তেজনা ক্রমশ আরো বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। অবশেষে নিজের হাতকে সে সবেগে আঘাত করিল; কিন্তু কোনো বেদনা বোধ করিল না। শেষে পকেটের ভিতর হইতে পিস্তল সংগ্রহ করিয়া লইয়া সে হরেনের দিকে সবেগে অগ্রসর হইতে লাগিল।
হরেন। ( চমকিয়া উঠিয়া ) এ কী! দাদা নাকি। তোমার দুটি পায়ে পড়ি দাদা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি— বাবাকে বলে দিয়ো না।
সতীশ। ( চিৎকার করিয়া ) মেসোমশায়— মেসোমশায়— এইবেলা রক্ষা করো— আর দেরি কোরো না— তোমার ছেলেকে এখনো রক্ষা করো।
শশধর। ( ছুটিয়া আসিয়া ) কী হয়েছে সতীশ। কী হয়েছে।
সুকুমারী। ( ছুটিয়া আসিয়া ) কী হয়েছে, আমার বাছার কী হয়েছে।
হরেন। কিছুই হয়নি মা— কিছুই না— দাদা তোমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছেন।
সুকুমারী। এ কিরকম বিশ্রী ঠাট্টা । ছি ছি, সকলই অনাসৃষ্টি! দেখো দেখি। আমার বুক এখনো ধড়াস-ধড়াস করছে। সতীশ মদ ধরেছে বুঝি!
সতীশ। পালাও— তোমাদের ছেলেকে নিয়ে এখনই পালাও। নইলে তোমাদের রক্ষা নেই।
শশধর। সতীশ, অমন উতলা হোয়ো না। ব্যাপারটা কী বলো। হরেনকে কার হাত হতে রক্ষা করবার জন্য ডেকেছিলে।
সতীশ। আমার হাত হতে। ( পিস্তল দেখাইয়া ) এই দেখো মেসোমশায়।
বিধু। সতীশ, তুই কোথায় কী সর্বনাশ করে এসেছিস বল্ দেখি। আপিসের সাহেব পুলিস সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়িতে খানাতল্লাসি করতে এসেছে। যদি পালাতে হয় তো এইবেলা পালা। হায় ভগবান! আমি তো কোনো পাপ করি নি, আমারই অদৃষ্টে এত দুঃখ ঘটে কেন।
সতীশ। ভয় নেই— পালাবার উপায় আমার হাতেই আছে!
শশধর। তবে কি তুমি—
সতীশ। তাই বটে মেসোমশায়— যা সন্দেহ করছ তাই। আমি চুরি করে মাসির ঋণ শোধ করেছি। আমি চোর। মা, শুনে খুশি হবে, আমি চোর, আমি খুনি। এখন আর কাঁদতে হবে না— যাও যাও, আমার সম্মুখ হতে যাও। আমার অসহ্য বোধ হচ্ছে।
শশধর। সতীশ, তুমি আমার কাছেও তো কিছু ঋণী আছ, তাই শোধ করে যাও।
সতীশ। বলো,কেমন করে শোধ করব। কী আমি দিতে পারি। কী চাও তুমি।
শশধর। ঐ পিস্তলটা দাও।
সতীশ। এই দিলাম। আমি জেলেই যাব। না গেলে আমার পাপের ঋণশোধ হবে না।
শশধর। পাপের ঋণ শাস্তির দ্বারা শোধ হয় না সতীশ,কর্মের দ্বারাই শোধ হয়। তুমি নিশ্চয় জেনো আমি অনুরোধ করলে তোমার বড়োসাহেব তোমাকে জেলে দেবেন না। এখন হতে জীবনকে সার্থক করে বেঁচে থাকো।
সতীশ। মেসোমশায়, এখন আমার পক্ষে বাঁচা যে কত কঠিন তা তুমি জান না— মরব নিশ্চয় জেনে পায়ের তলা হতে আমার শেষ সুখের অবলম্বনটা আমি পদাঘাতে ফেলে দিয়ে এসেছি— এখন কী নিয়ে বাঁচব।
শশধর। তবু বাঁচতে হবে, আমার ঋণের এই শোধ— আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে না।
সতীশ। তবে তাই হবে।
শশধর। আমার একটা অনুরোধ শোনো। তোমার মাকে আর মাসিকে অন্তরের সহিত ক্ষমা করো।
সতীশ। তুমি যদি আমাকে ক্ষমা করতে পার, তবে এ সংসারে কে এমন থাকতে পারে যাকে আমি ক্ষমা করতে না পারি।
মা, আশীর্বাদ করো,আমি সব যেন সহ্য করতে পারি— আমার সকল দোষগুণ নিয়ে তোমরা আমাকে যেমন গ্রহণ করেছ, সংসারকে আমি যেন তেমনি করে গ্রহণ করি।
বিধু। বাবা, কী আর বলব। মা হয়ে আমি তোকে কেবল স্নেহই করেছি, তোর কোনো ভালো করতে পারি নি— ভগবান তোর ভালো করুন। দিদির কাছে আমি একবার তোর হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করে নিই গে।
শশধর। তবে এসো সতীশ, আমার ঘরে আজ আহার করে যেতে হবে।
নলিনী। সতীশ!
সতীশ। কী নলিনী।
নলিনী। এর মানে কী। এ চিঠি তুমি আমকে কেন লিখেছ।
সতীশ। মানে যেমন বুঝেছিলে সেইটেই ঠিক। আমি তোমাকে প্রতারণা করে চিঠি লিখি নি। তবে আমার ভাগ্যক্রমে সকলই উলটা হয়। তুমি মনে করতে পার, তোমার দয়া উদ্রেক করবার জন্যই আমি— কিন্তু মেসোমশায় সাক্ষী আছেন, আমি অভিনয় করছিলেম না— তবু যদি বিশ্বাস না হয়, প্রতিজ্ঞারক্ষা করবার এখনো সময় আছে।
নলিনী। কী তুমি পাগলের মতো বকছ। আমি তোমার কী অপরাধ করেছি যে তুমি আমাকে এমন নিষ্ঠুর ভাবে—
সতীশ। যেজন্য আমি সংকল্প করেছি সে তুমি জান, নলিনী— আমি তো একবর্ণও গোপন করি নি, তবু কি আমার উপর তোমার শ্রদ্ধা আছে।
নলিনী। শ্রদ্ধা! সতীশ, তোমার উপর ঐজন্যই আমার রাগ ধরে। শ্রদ্ধা, ছি ছি , শ্রদ্ধা তো পৃথিবীতে অনেকেই অনেককে করে। তুমি যে কাজ করেছ আমিও তাই করেছি— তোমাতে আমাতে কোনো ভেদ রাখি নি। এই দেখো, আমার গহনাগুলি সব এনেছি— এগুলি এখনো আমার সম্পত্তি নয়— এগুলি আমার বাপ-মায়ের। আমি তাঁদিগকে না বলে এনেছি, এর কত দাম হতে পারে আমি কিছুই জানি নে; কিন্তু এ দিয়ে কি তোমার উদ্ধার হবে না।
শশধর। উদ্ধার হবে, এই গহনাগুলির সঙ্গে আরো অমূল্য যে ধনটি দিয়েছ তা দিয়েই সতীশের উদ্ধার হবে।
নলিনী। এই-যে শশধরবাবু, মাপ করবেন, তাড়াতাড়িতে আপনাকে আমি—
শশধর। মা, সেজন্য লজ্জা কী। দৃষ্টির দোষ কেবল আমাদের মতো বুড়োদেরই হয় না— তোমাদের বয়সে আমাদের মতো প্রবীণ লোক হঠাৎ চোখে ঠেকে না। সতীশ, তোমার আপিসের সাহেব এসেছেন দেখছি। আমি তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে আসি, ততক্ষণ তুমি আমার হয়ে অতিথিসৎকার করো। মা, এই পিস্তলটা এখন তোমার জিম্মাতেই থাকতে পারে।
পৌষ ১৩১০
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।