কমলাকান্তের জোবানবন্দী—–বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়– দ্বিতীয় অংশ

কমলা। আমি কি একটা জাতি?

উকীল । তুমি কোন্ জাতীয়।

কমলা। হিন্দু জাতীয়।

উকীল । আঃ! কোন্ বর্ণ?

কমলা। ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ।

উকীল । দূর হোক ছাই! এমন সাক্ষীও আনে! বলি তোমার জাত আছে?

কমলা। মারে কে?

হাকিম দেখিলেন, উকীলের কথায় হইবে না। বলিলেন, “ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, কৈয়বর্ত্ত, হিন্দুর নানা প্রকার জাতি আছে জান ত-তুমি তার কোন জাতির ভিতর?”

কমলা। ধর্ম্মাবতার! এ উকীলের ধৃষ্টতা! দেখিতেছেন আমার গলায় যজ্ঞোপবীত, নাম বলিয়াছি চক্রবর্ত্তী-ইহাতেও যে উকীল বুঝেন নাই যে, আমি ব্রাহ্মণ, ইহা আমি কি প্রকারে জানিব?

হাকিম লিখিলেন, “জাতি ব্রাহ্মণ |” তখন উকীল জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার বয়স কত?”

এজ্লাসে একটা ক্লক ছিল-তাহার পানে চাহিয়া হিসাব করিয়া কমলাকান্ত বলিল, “আমার বয়স একান্ন বৎসর, দুই মাস, তের দিন, চারি ঘণ্টা, পাঁচ মিনিট ___”

উকীল । কি জ্বালা! তোমার ঘণ্টা মিনিট কে চায়?

কমলা। কেন, এইমাত্র প্রতিজ্ঞা করাইয়াছেন যে, কোন কথা গোপন করিব না।

উকীল । তোমার যা ইচ্ছা কর! আমি তোমায় পারি না। তোমার নিবাস কোথা?

কমলা। আমার নিবাস নাই।

উকীল । বলি, বাড়ী কোথা?

কমলা। বাড়ী দূরে থাক, আমার একটা কুঠারীও নাই।

উকীল । তবে থাক কোথা?

কমলা। যেখানে সেখানে।

উকীল । একটা আড্ডা ত আছে?

কমলা। ছিল, যখন নসী বাবু ছিলেন। এখন আর নাই।

উকীল । এখন আছ কোথা?

কমলা। কেন, এই আদালতে।

উকীল । কাল ছিলে কোথা?

কমলা। একখানা দোকানে।

হাকিম বলিলেন, “আর বকাবকিতে কাজ নাই-আমি লিখিয়া লইতেছি, নিবাস নাই। তারপর?

উকীল । তোমার পেশা কি?

কমলা। আমার আবার পেশা কি? আমি কি উকীল না বেশ্যা যে, আমার পেশা আছে?

উকীল । বলি, খাও কি করিয়া?

কমলা। ভাতের সঙ্গে ডাল মাখিয়া, দক্ষিণ হস্তে গ্রাস তুলিয়া, মুখে পুরিয়া গলাধঃকরণ করি।

উকীল । সে ডাল ভাত জোটে কোথা থেকে?

কমলা। ভগবান্ জোটালেই জোটে, নইলে জোটে না।

উকীল । কিছু উপার্জ্জন কর?

কমলা। এক পয়সাও না।

উকীল । তবে কি চুরি কর?

কমলা। তাহা হইলে ইতিপূর্ব্বেই আপনার শরণাগত হইতে হইত। আপনি কিছু ভাগও পাইতেন।

উকীল তখন হাল ছাড়িয়া দিয়া, আদালতকে বলিলেন, “আমি এ সাক্ষী চাহি না। আমি ইহার জোবানবন্দী করাইতে পারিব না |”

প্রসন্ন বাদিনী, উকীলের কোমর ধরিল; বলিল, “এ সাক্ষী ছাড়া হইবে না। এ বামন সত্য কথা বলিবে, তাহা আমি জানি-কখনও মিছা বলে না। উহাকে তোমরা জিজ্ঞাসা করিতে জান না-তাই ও অমন করিতেছে। ও বামনের আবার পেশা কি? ও এর বাড়ী ওর বাড়ী খেয়ে বেড়ায়, ওকে জিজ্ঞাসা করিতেছ, উপার্জ্জন কর! ও কি বলবে?”

উকীল তখন হাকিমকে বলিল, “লিখুন, পেশা ভিক্ষা |”

এবার কমলাকান্ত রাগিল, “কি? কমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী ভিক্ষোপজীবী? আমি মুক্তকণ্ঠে হলফের উপর বলিতেছি, আমি কখনও কাহারও কাছে এক পয়সা ভিক্ষা চাই না |”

প্রসন্ন আর থাকিতে পারিল না-সে বলিল, “সে কি ঠাকুর! কখন আফিঙ্গ চেয়ে খাও নাই?”

কমল। দূর মাগি ধেমো গোয়ালার মেয়ে! আফিঙ্গ কি পয়সা! আমি কখন একটি পয়সাও কাহারও কাছে ভিক্ষা লই নাই।

হাকিম হাসিয়া বলিলেন, “কি লিখিব কমলাকান্ত?”

কমলাকান্ত নরম হইয়া বলিল, “লিখুন, পেশা ব্রাহ্মণভোজনের নিমন্ত্রণ-গ্রহণ” সকলে হাসিল-হাকিম তাই লিখিয়া লইলেন।

তখন উকীল মহাশয় মোকদ্দমায় প্রবৃত্ত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি ফরিয়াদীকে চেন?”

কমল। না।

প্রসন্ন হাঁকিল, “সে কি ঠাকুর! চিরটা কাল আমার দুধ দই খেলে, আজ বল চিনি না?”

কমলাকান্ত বলিল, “তোমার দুধ দই চিনি না, এমন কথা ত বল্‌তেছি না-তোমার দুধ দই বিলক্ষণ চিনি। যখনই দেখি এক পোয়া দুধে তিন পোয়া জল, তখনই চিনিতে পারি যে, এ প্রসন্ন গোয়ালিনীর দুধ; যখনই দেখ্‌তে পাই যে, ঘোলের চেয়ে দই ফিকে, তখনই চিনতে পারি যে, এ প্রসন্নময়ীর দুধ। দুধ দই চিনি নে?”

প্রসন্ন নথ ঘুরাইয়া বলিল, “আমার দুধ দই চেন, আর আমায় চিনিতে পার না?”

কমলাকান্ত বলিল, “মেয়েমানুষকে কে কবে চিনিতে পেরেছে, দিদি? বিশেষ, গোয়ালার মেয়ের কাঁকালে যদি দুধের কেঁড়ে থাকিল, তবে কার বাপের সাধ্য তাকে চিনে উঠে?”

উকীল তখন আবার সওয়াল করিতে লাগিলেন, “বুঝা গেল; তুমি বাদিনীকে চেন-উহার সঙ্গে তোমার কোন সম্বন্ধ আছে?”

কমল। মন্দ নয়-এত গুণ না থাকিলে কি উকীল হয়!

উকীল । তুমি আমার কি গুণ দেখিলে?

কমল। বামনের ছেলে গোয়ালার মেয়েতেও আপনি একটা সম্বন্ধ খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন।

উকীল । এমন সম্বন্ধ কি হয় না? কে জানে তুমি ওর পোষ্যপুত্র কি না?

কমল। ওর নয়, কিন্তু ওর গাইয়ের বটে।

উকীল । বুঝা গেল, তোমার সঙ্গে বাদিনীর একটা সম্বন্ধ আছে, একেবারে সাফ বলিলেই হইত-এত দুঃখ দাও কেন? এখন জিজ্ঞাসা করি, তুমি এ মোকদ্দমার কি জান?

কমল। জানি যে, এ মোকদ্দমায় আপনি উকীল, প্রসন্ন ফরিয়াদী, আমি সাক্ষী আর এই নেড়ে আসামী।

উকীল । তা নয়, গোরুচুরির কি জান?

কমল। গোরুচুরির আমার বাপ-দাদাও জানে না। বিদ্যাটা আমায় শিখাইবেন?-আমার দুধ দধির বড় দরকার।

উকীল । আঃ-বলি গোরুচুরি দেখিয়াছ?

কমল। একদিন দেখিয়াছিলাম। নসী বাবুর একটা বক্‌না-এক বেটা মুচি-

উকীল । কি যন্ত্রণা! বলি, প্রসন্ন গোয়ালিনীর গোরু যখন চুরি যায়, তখন তুমি দেখিয়াছ?

কমল। না-চোর বেটার এত বুদ্ধি হয় নাই যে, আমাকে ডাকিয়া সাক্ষী রাখিয়া গোরুটা চুরি করে। তাহা হইলে আপনারও কাজে সুবিধা হইত, আমারও কাজের সুবিধা হইত।

গল্পের তৃতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দুঃখিত!