অল্পে অল্পে শুনিলাম, এই বিবাহে ডাক্তার বারো হাজার টাকা পাইবেন ।
কিন্তু আমার কাছে এ সংবাদ গোপন করিয়া আমাকে অপমান করিবার তাৎপর্য কী । আমি কি তাঁহার পায়ে ধরিয়া বলিয়াছিলাম যে , এমন কাজ করিলে আমি বুক ফাটিয়া মরিব । পুরুষদের বিশ্বাস করিবার জো নাই । পৃথিবীতে আমি একটিমাত্র পুরুষ দেখিয়াছি এবং এক মুহূর্তে সমস্ত জ্ঞান লাভ করিয়াছি ।
ডাক্তার রোগী দেখিয়া সন্ধ্যার পূর্বে ঘরে আসিলে আমি প্রচুর পরিমাণে হাসিতে হাসিতে বলিলাম , ‘ কী ডাক্তার- মহাশয়, আজ নাকি আপনার বিবাহ। ‘
আমার প্রফুল্লতা দেখিয়া ডাক্তার যে কেবল অপ্রতিভ হইলেন তাহা নহে , ভারি বিমর্ষ হইয়া গেলেন ।
জিজ্ঞাসা করিলাম , ‘ বাজনা-বাদ্য কিছু নাই যে। ‘
শুনিয়া তিনি ঈষৎ একটু নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন , ‘ বিবাহ ব্যাপারটা কি এতই আনন্দের । ‘
শুনিয়া আমি হাসিয়া অস্থির হইয়া গেলাম । এমন কথাও তো কখনো শুনি নাই । আমি বলিলাম , ‘ সে হইবে না , বাজনা চাই , আলো চাই । ‘
দাদাকে এমনি ব্যস্ত করিয়া তুলিলাম যে, দাদা তখনই রীতিমত উৎসবের আয়োজনে প্রবৃত্ত হইলেন ।
আমি কেবলই গল্প করিতে লাগিলাম বধূ ঘরে আসিলে কী হইবে , কী করিব । জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ আচ্ছা ডাক্তার- মহাশয় , তখনো কি আপনি রোগীর নাড়ী টিপিয়া বেড়াইবেন । ‘ হি হি! হি হি! যদিও মানুষের বিশেষত পুরুষের মনটা দৃষ্টিগোচর নয় , তবু আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি, কথাগুলি ডাক্তারের বুকে শেলের মতো বাজিতেছিল ।
অনেক রাত্রে লগ্ন । সন্ধ্যাবেলায় ডাক্তার ছাতের উপর বসিয়া দাদার সহিত দুই-এক পাত্র মদ খাইতেছিলেন । দুইজনেরই এই অভ্যাসটুকু ছিল । ক্রমে আকাশে চাঁদ উঠিল ।
আমি হাসিতে হাসিতে আসিয়া বলিলাম , ‘ ডাক্তার-মশায় ভুলিয়া গেলেন নাকি । যাত্রার যে সময় হইয়াছে । ‘
এইখানে একটা সামান্য কথা বলা আবশ্যক । ইতিমধ্যে আমি গোপনে ডাক্তারখানায় গিয়া খানিকটা গুঁড়া সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিলাম এবং সেই গুঁড়ার কিয়ংদশ সুবিধামত অলক্ষিতে ডাক্তারের গ্লাসে মিশাইয়া দিয়াছিলাম । কোন্ গুঁড়া খাইলে মানুষ মরে ডাক্তারের কাছে শিখিয়াছিলাম ।
ডাক্তার এক চুমুকে গ্লাসটি শেষ করিয়া কিঞ্চিৎ আর্দ্র গদ্গদ কণ্ঠে আমার মুখের দিকে মর্মান্তিক দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন , ‘ তবে চলিলাম । ‘
বাঁশি বাজিতে লাগিল, আমি একটি বারাণসী শাড়ি পরিলাম; যতগুলি গহনা সিন্দুকে তোলা ছিল সবগুলি বাহির করিয়া পরিলাম- সিঁথিতে বড়ো করিয়া সিঁদুর দিলাম । আমার সেই বকুলতলায় বিছানা পাতিলাম ।
বড়ো সুন্দর রাত্রি । ফুট্ফুটে জ্যোৎস্না । সুপ্ত জগতের ক্লান্তি হরণ করিয়া দক্ষিনে বাতাস বহিতেছে । জুঁই আর বেল ফুলের গন্ধে সমস্ত বাগান আমোদ করিয়াছে ।
বাঁশির শব্দ যখন ক্রমে দূরে চলিয়া গেল , জ্যোৎস্না যখন অন্ধকার হইয়া আসিতে লাগিল , এই তরুপল্লব এবং আকাশ এবং আজন্মকালের ঘরদুয়ার লইয়া পৃথিবী যখন আমার চারি দিক হইতে মায়ার মতো মিলাইয়া যাইতে লাগিল তখন আমি নেত্র নিমীলন করিয়া হাসিলাম ।
ইচ্ছা ছিল যখন লোকে আসিয়া আমাকে দেখিবে তখন এই হাসিটুকু যেন রঙিন নেশার মতো আমার ঠোঁটের কাছে লাগিয়া থাকে । ইচ্ছা ছিল যখন আমার অনন্তরাত্রির বাসর-ঘরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করিব তখন এই হাসিটুকু এখান হইতেই মুখে করিয়া লইয়া যাইব । কোথায় বাসর-ঘর। আমার সে বিবাহের বেশ কোথায় । নিজের ভিতর হইতে একটা খট্খট্ শব্দে জাগিয়া দেখিলাম , আমাকে লইয়া তিনটি বালক অস্থিবিদ্যা শিখিতেছে। বুকের যেখানে সুখদুঃখ ধুক্ধুক্ করিত এবং যৌবনের পাপড়ি প্রতিদিন একটি একটি করিয়া প্রস্ফুটিত হইত সেইখানে বেত্র নির্দেশ করিয়া কোন্ অস্থির কী নাম মাস্টার শিখাইতেছে । আর, সেই যে অন্তিম হাসিটুকু ওষ্ঠের কাছে ফুটাইয়া তুলিয়াছিলাম তাহার কোনো চিহ্ন দেখিতে পাইয়াছিলে কি । ”
“ গল্পটা কেমন লাগিল । ”
আমি বলিলাম , “ গল্পটি বেশ প্রফুল্লকর । ”
এমন সময় প্রথম কাক ডাকিল । জিজ্ঞাসা করিলাম , “ এখনো আছ কি । ” কোনো উত্তর পাইলাম না ।
ঘরের মধ্যে ভোরের আলো প্রবেশ করিল ।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।