ওমরের ইসলাম গ্রহণ

হযরত ওমর (রাঃ) ক্রোধান্বিত অবস্থায় মজলিস থেকে উন্মুক্ত তরবারী নিয়ে সাইয়্যেদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে হত্যার জন্য যাত্রা করল পথে হযরত নোয়াইমের সাথে তার সাক্ষাত হয়। হযরত নোয়াইম পূর্বেই ইসলাম কবুল করেছিলেন।

কিন্তু ওমরের তা অজ্ঞাত ছিল। নোয়াইম ওমরের বংশেরই একজন লোক। তিনি হযরত ওমরের চলার গতিবিধি দেখে সঙ্কিত হলেন। তাই হযরত ওমরের গোসসা গন্তব্যস্থানে পৌঁছার আগেই ঠান্ডা হোক এটাই তার কাম্য ছিল। তিনি ওমরকে বলেন, ওমর! তুমি কোথায় যাও? ওমর বলল, মুহাম্মদকে হত্যা করতে। নোয়াইম বলল, প্রথমে তোমার ঘরের খবর লও। তোমার ভগ্নিপতি সায়ীদ এবং তোমার ভগ্নি ফাতেমাও মুসলমান হয়েছে।


একথা শুনে ওমর আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার মত জ্বলে উঠল। উন্মুক্ত তরবারী নিয়ে গতি পরিবর্তন করে ভগ্নীর গৃহে প্রবেশ করল। ভগ্নি তখন সূরায়ে তোয়াহা তিলাওয়াত করছিল। ওমরের আগমনের আওয়াজ পেয়ে তিলাওয়াত বন্ধ করে তা গোপন করে ফেলল। ওমর জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি পাঠ করছিলে? আমাকে বল। ফাতেমা বলল কিছুই না।

ওমর বলল, আমি শুনেছি তোমরা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছ। এ কথা বলে ওমর তার ভগ্নীপতিকে আক্রমণ করে প্রহার করতে শুরু করল। ফাতেমা তার স্বামীকে প্রহার থেকে বাঁচানোর জন্য তার উপর উপুড় হয়ে পড়ল এবং ওমরকে প্রহার বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করতে লাগল। কিন্তু ওমর আরও অধিক পরিমাণে প্রহার করতে লাগল এবং ভগ্নীকেও প্রহার করল।

ওমরের প্রচন্ড আঘাতে ভগ্নী ও ভগ্নীপতি উভয়ের দেহ থেকে রক্ত ধারা প্রবাহিত হল। এবার ভগ্নী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বলল, ওমর! আমরা ইসলাম গ্রহণ করছি। তুমি যত ইচ্ছা প্রহার করতে পার। কিন্তু আমরা ঈমান ছাড়তে পারব না। আমাদের হৃদয় পটে ঈমানের আলো এত শক্তিশালী ও মজবুত হয়ে বসেছে যে, শত অত্যাচার ও আঘাত তিলমাত্র ঈমানকে স্থানচ্যুত করতে পারবে না।

ভগ্নির এহেন তেজদীপ্ত কথা শুনে ওমরের পাষান হৃদয় বিগলিত হয়ে গেল। তাদেরকে প্রহার করা বন্ধ করল। একটু পরই ভগ্নীকে বলল, তুমি যা পড়ছিলে আমাকে তা দর্শন করাও। ভগ্নি ওমরকে কোরআন দিতে অস্বীকার করল। বললেন, তুমি নাপাক আর আল্লাহর কালাম অপবিত্র লোক স্পর্শ করতে পারে না। তুমি কোরআন দর্শন করতে চাইলে পাক পবিত্র হয়ে আস।


অনন্তর ওমর যখন গোসল করে আসল তখন তার ভগ্নী তাঁর হাতে কোরআনের অংশগুলো তুলে দিল। ওমর সূরায়ে তোয়াহার আয়াতগুলো তিলাওয়াত করে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে গেল।
অনিচ্ছা সত্বেও সে বলে উঠল “আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ-হ”।
হযরত খাব্বাব ফাতেমার গৃহে লুকিয়ে ছিল। এই অবস্থা দেখে সে সামনে এসে বলল, হে ওমর! রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দোয়া আল্লাহর দরবারে তোমার শানে কবূল হয়েছে।


আমি গতকাল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দোয়া করতে শুনেছি। হে আল্লাহ! তুমি আবু জাহেল অথবা ওমরের দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী করে দাও। হে ওমর! তুমি আল্লাহকে ভয় কর। ওমর বলল, আমাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দরবারে নিয়ে চল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন সাফা পর্বতের পাদদেশে জায়েদ বিন আরকামের ঘরে অবস্থান করছিলেন। হযরত ওমর (রাঃ) উন্মুক্ত তরবারী নিয়ে সেই গৃহের দিকে ধাবিত হলেন। হযরত হামজা (রাঃ) ঐ গৃহের দরজায় দাঁড়ানো ছিলেন।

ওমর (রাঃ)-এর আগমণে অনেকেই ভয় পাচ্ছিলেন। গতরাতে দারুন নদওয়ায় মজলিসের সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাঁরা অবগত ছিল। মনে করল, সেই প্রস্তাব অনুযায়ী ওমর নবীজীকে হত্যা করবার জন্য আসছে। হযরত্ হামযা (রাঃ) বলেন, যদি ওমর সৎ উদ্দেশ্যে এসে থাকে তা হলে তো ভাল কথা। আর যদি অসৎ উদ্দেশ্যে এসে থাকে তা হলে তার তরবারী দিয়েই তাকে খতম করে দিব।


রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ওমরকে আসতে দাও, বাধা দিও না। হযরত ওমর (রাঃ) সরাসরি গৃহে প্রবেশ করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নুরানী চেহারা দর্শনে আত্নহারা হয়ে দ্বিধাহীন ভাবে বলে উঠল, “আশহাদু আল আল-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াআশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লা-হ।” হযরত ওমর (রাঃ) -এর কালেমা পড়বার সাথে সাথে মুসলমানদের মধ্যে আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খুশীতে “নারায়ে তকবীর, আল্লাহু আকবর” ধ্বনি দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সাহাবারাও একই সঙ্গে নারায়ে তাকবীরের ধ্বনি দিলেন। সমবেত কন্ঠে আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে সমগ্র আরব কাঁপিয়া উঠল।

আরবের পর্বতমালায় উহার প্রতিধ্বনি উঠল। ওমরের পূর্বে মাত্র উনচল্লিশ জন নর-নারী মুসলমান হয়েছিল। হযরত ওমর (রাঃ) সহ চল্লিশ জন হল।


হযরত ওমর (রাঃ) ইসলাম গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানগণ চুপে চুপে কোরআন পাঠ করত। ঈমান ও ইসলাম গ্রহণ গোপন রাখত। কাফেরদের ভয়ে প্রকাশ্যে নামায আদায় করত না। হযরত ওমর (রাঃ) বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! জীবনে মরণে আমরা কি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নই? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলিলেন, অবশ্যই। হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, তা হলে আমরা কেন গোপনে আল্লাহর নাম নিব। দ্বীনকে কেন গোপন রাখব? আল্লাহর ঘরে তারা মূর্তির নাম বুলন্দ আওয়াজ নেয়।

অথচ ঘরের মালিকের নাম আমরা গোপনে নেই। এটা কখনও হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন। ওমর আমরা সংখ্যায় কম। আমাদের প্রতি যে উৎপীড়ন ও নির্যাতন চলছে তা তুমি সম্যক অবগত। হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর কসম, আমি কাফেরদের মজলিসে ঈমানের কলেমা বুলন্দ করব। এ বলে হযরত ওমর সোজা কাবা ঘরে চলে যান।

খানায়ে কাবার তাওয়াফ করতে লাগলেন, তাঁর উন্মুক্ত তরবারী এখনও উন্মুক্ত অবস্থায়ই রয়ে গেছে। হযরত ওমর (রাঃ) উচ্চঃস্বরে কালেমা পড়তে লাগলেন। আর কুরাইশ নেতৃবর্গের নাম ধরে ডেকে ডেকে বলতে লাগলেন। তোমাদের মধ্যে কে আছ আমাকে বাধা দেয়ার-আস, আমি ইসলাম গ্রহণ করছি। যদি কারো তার স্ত্রীকে বিধবা করতে ইচ্ছা থাকে অথবা ছোট শিশুকে এতীম করতে চাও, তা হলে ওমরের সামনে আস।


আবূ জাহেল আবূ লাহাব প্রমুখ কুরাইশ নেতৃবর্গ চতুর্দিকে সমবেত হয়ে ওমরের মুখপানে এক দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে রইল এতীম করতে চাও, তা হলে ওমরের সামনে আস।
আবূ জাহেল আবূ লাহাব প্রমুখ কুরাইশ নেতৃবর্গ চতুর্দিকে সমবেত হয়ে ওমরের মুখপানে এক দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে রইল কারও সাহস হয়নি ওমরের কথার উত্তর দিতে।


হযরত ওমর (রাঃ) এর এরুপ নাটকীয়ভাবে ইসলাম গ্রহনের কথা কোন ঐতিহাসিক স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে এ নাটকিয়তা সৃষ্টির পিছনে এর পর্বের আরো কিছু ঘটনা কাজ করেছে। আমের বিন রবিয়ার স্ত্রীর বর্ণনা থেকে জানা যায়। কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অপরাপর মুসলমানদের ন্যায় তাঁরাও দেশ ত্যাগের আয়োজন করছিলেন সে সময়ও ওমর সেখানে উপস্থিত ছিল তখন হযরত ওমর (রাঃ) এ দুস্থ পরিবারের অবস্থা দেখে খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন।


হাদীস গ্রন্থে স্বয়ং হযরত ওমরের বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে, একদা তিনি গভীর রাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর অনিষ্ঠ সাধনের লক্ষ্যে তাঁর অনুসরণ করেন। সেই নিভৃত নিস্তব্ধ নিশীতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাবায় প্রবেশ করে নামায পড়ছিলেন। হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, আমি কাবার পর্দার আড়ালে একেবারে সন্নিকটে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। নবীজী (সাঃ) নামাযে আলহাক্কা সূরা তিলাওয়াত করছিলেন। তাঁর তিলাওয়াত শুনতে শুনতে মুহূর্তে মুহূর্তে আমার মন পরিবর্তিত হচ্ছিল।

তখন আমার মনে হল, কোরাইশরা ঠিকই বলেছে ইনি আসলে একজন উঁচু মানের কবি। ঠিক তখনই তিনি তিলাওয়াত করলেন-
অর্থঃ যা কিছু দেখছ আর যা দেখছ না, এ সবের কসম! এ আমার রাসূল কর্তৃক প্রচারিত আমার বাণী, তা কবির কল্পনা নয়, কিন্তু তোমরা তাতে কমই বিশ্বাস করে থাক।
এবার ওমর (রাঃ) ভাবনায় পড়লেন-ইনি নিশ্চয় কোন গনক হবেন, নতুবা আমার মনের কল্পনা জানতে পারলেন কি করে? আমার মনে এভাবের উদয় হতেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তেলাওয়াত করলেনঃ “এ কোন গণকের উক্তি নয়, তোমরা খুব কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাক”।


হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, উক্ত ঘটনার পরই ইসলাম আমার হৃদয়ে যথেষ্ট স্থান করে নেয়।
উল্লিখিত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, হযরত ওমর (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণ কোন নাটকীয় ব্যাপার নয়; বরং আগে থেকেই সংঘটিত কিছু ঘটনার ফল নাটকীয়ভাবে নোয়াইম বিন আবদুল্লাহ সংক্রান্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে আত্নপ্রকাশ করে।

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।