ঐক্যের গুরুত্ব

রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা সবাই নিশ্চয়ই ‘একতাই বল’ কিংবা ‘একতাই শক্তি’ বাংলা এ প্রবাদ দুটো শুনেছ। এ প্রবাদ দু’টিতে একতার প্রতি এজন্যই জোর দেয়া হয়েছে যে, একতাবদ্ধ থাকলে মানুষ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কখনও বাইরের শত্রুদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যদি কোন বিপদ এসেই পড়ে তখন সবাই পরামর্শ করে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে তা মোকাবেলা করা সহজ হয়।

আর এ কারণেই পবিত্র কোরআন ও হাদিসে অনেক বার ঐক্যের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে মুসলমানদের ঐক্যের ব্যাপারে বলেছেন, “তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে ভালোভাবে দৃঢ়তার সাথে ধারণ করো মজবুতভাবে ধারণ করো। পরস্পর তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ো না ।” অন্যদিকে রাসূল (সা.) তাঁর উম্মতদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “তোমরা একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না ও মুখ ফিরিয়ে নিও না এবং একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করো না বরং তোমরা নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং ঐক্যবদ্ধ থাকবে৷”

মুসলমানরা যতদিন পবিত্র কোরআন ও রাসূলে খোদার এ আদেশ মেনে চলেছে ততদিন জ্ঞান-বিজ্ঞান, সামরিক শক্তিসহ সবকিছুতেই তারা ছিল উন্নত ও অগ্রগামী। কিন্তু নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির পর মুসলমানদের পতন শুরু হয় এবং তারা সব দিক থেকে অন্যান্য জাতির চেয়ে পিছিয়ে পড়ে। এখনও যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকি এবং সবাই মিলে শত্রুর মোকাবেলা করি তাহলে আবারো আমরা আমাদের হারানো মর্যাদা ফিরে পাবো।

বন্ধুরা, ঐক্যের গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা প্রায় দু’হাজার বছর আগে রচিত বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ ‘কালিলা-দিমনা’ থেকে একটি গল্প রংধনু আসরে প্রচার করেছি। একবার এক কাক নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় বেড়াতে গেল। সেখানে গিয়ে নয়ন জুড়িয়ে নতুন নতুন জিনিস দেখতে লাগল। হঠাৎ একটা শব্দে পেছনে তাকাতেই দেখতে পেল, একজন শিকারি তারই দিকে এগিয়ে আসছে।

শিকারিকে দেখে কাক একটু ভয় পেয়ে গেল। তবে সেখান থেকে না পালিয়ে বরং শিকারি কি করে তা দেখার জন্য একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। এ সময় শিকারি কাকের পাশ দিয়ে কিছুদূর সামনে গিয়ে একটি জাল পেতে তাতে কিছু শস্যদানা ছড়িয়ে দিল। এরপর একটি ঝোপের আড়ালে গিয়ে বসে পড়ল।

কিছুক্ষণের মধ্যে ওই পথ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল একঝাঁক কবুতর। মাটিতে শস্যদানা দেখে তারা নিচে নেমে এলো। কবুতরদের সর্দার ছিল বেশ বয়স্ক ও বুদ্ধিমান। কোন বিপদাপদ আছে কিনা তা পরীক্ষা না করে শস্য খেতে নিষেধ করল। কিন্তু বাকী কবুতররা তার কোন কথাই শুনল না। তারা দেরি না করে শস্য খাওয়া শুরু করল।

দু’এক পা নড়তেই সবাই বুঝতে পারল যে, তারা শিকারির ফাঁদে আটকা পড়েছে।

ফাঁদে পড়ে তাদের আর দুঃখের অন্ত রইল না। প্রত্যেকেই যার যার নখ ও ঠোঁট দিয়ে জাল ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কোনো চেষ্টাই কাজে লাগল না। শিকারি যখন বুঝতে পারল যে, কবুতররা তার ফাঁদে আটকা পড়েছে তখন সে খুশিতে গদগদ হয়ে ছুটে গেল জালের দিকে। এ সময় কবুতরদের সর্দার সবাইকে ডেকে বলল: “তোমরা সবাই আমার কথা অমান্য করে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে ফাঁদে আটকা পড়েছে। তবে এ সব বলে তো এখন কোনো লাভ নেই। এখন আমাদের সামনে বাঁচার একটা উপায় আছে- আর তা হলো, সব একজোট হয়ে জালসহ আকাশে উড়ে যেতে হবে।”

সর্দারের পরামর্শ অনুযায়ী বাঁচার তাগিদে সবাই একযোগ জালসহ পাখা মেলে আকাশে উড়া শুরু করল। এ দৃশ্য দেখে শিকারি বেচারা একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল! এরপর দৌড়াতে শুরু করল কবুতরদের পিছুপিছু। কিন্তু কিছুক্ষণের ভেতরেই কবুতররা জাল নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল আকাশে। শিকারি ফিরে গেল তার পথে।

শিকারি চলে গেল কবুতররা তাদের সর্দারের কাছে জাল থেকে বাঁচার উপায় জানতে চাইল। সর্দার বলল : “বাইরের সাহায্য না পেলে এ জাল থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই। তবে তোরা নিরাশ হবিনে। কাছেই একটা ভাঙ্গা বাড়িতে আমার এক ইঁদুর বন্ধু থাকে। তার কাছে গেলেই সে আমাদের পায়ের সাথে লেগে থাকা সুতাগুলো কেটে দিতে পারবে।”

এরপর কবুতররা পৌঁছে গেল ওই ভাঙ্গা বাড়িতে। ওখানে নেমে পড়ল সবাই। কবুতরদের সর্দার তার ইঁদুর বন্ধুকে ডাক দিতেই সে গর্ত থেকে বের হয়ে এল। বহুদিন পর কবুতর বন্ধুকে দেখে ইঁদুর খুব খুশি হল। তবে সবার পায়ে জাল দেখে ইঁদুরটি দুঃখ প্রকাশ ও আফসোস করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর ইঁদুর কবুতর সর্দারের কাছে বলল: “আচ্ছা বন্ধু! এত বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও সাবধানতার সত্ত্বেও তুমি কি করে এমন বিপদে পড়লে?” কবুতর সর্দার বলল: “দানার লোভ আর বেশী তাড়াহুড়া করাতেই এ বিপদে পড়লাম। তবে সত্য কথা কি জানো, বুদ্ধিমানের কখনো বিপদে পড়ে শক্তি ও সাহস হারায় না। তারা নিরাশও হয় না। আমরাও নিরাশ হইনি। আর তাইতো তোমার কাছে ছুটে এসেছি। তো বন্ধু আমার, আর কথা না বাড়িয়ে এবার আমাদের মুক্তি দাও।”

ইঁদুর তাড়াতাড়ি সুতা কাটার জন্য কবুতর সর্দারের কাছে গেল। কিন্তু সর্দার প্রথমে তার বন্ধুদের পায়ের সুতা কাটার অনুরোধ করল। এ সময় ইঁদুর বলল : “আরে বাবা, ওদেরগুলোও তো খুলব। তবে তুমি হচ্ছে এদের সর্দার। তাছাড়া, তুমি আমার বন্ধু। তাই তোমাকে আগে মুক্ত করতে চাই।”

কবুতর সর্দার বলল: “আমাকে নিশ্চয়ই মুক্ত করবে। কিন্তু আমাকে মুক্ত করতে গিয়ে তুমি যদি ক্লান্ত হয়ে পড় তাহলে আমার বন্ধুরা সবাই হয়তো মুক্ত হতে পারবে না। তাই আগে ওদেরকে মুক্ত কর। তাছাড়া আমি হচ্ছি ওদের নেতা। আমার দায়িত্ব হলো তাদের কল্যাণ ও স্বার্থ দেখা।” ইঁদুর বলল: “তুমি সত্যি সত্যিই একজন আদর্শ নেতা। তোমার কথায় আমি পুরোপুরি মুগ্ধ।” এ কথা বলেই ইঁদুর বিপুল উৎসাহ নিয়ে সূতা কাটায় লেগে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যে জাল কাটা হয়ে কবুতররা মুক্তি পেল। তখন তাদের আনন্দ আর দেখে কে! ইঁদুরকে ঘিরে তারা নেচে নেচে গাইতে লাগল ‘বাকবাকুম বাকবাকুম।’ এভাবে কিছুক্ষণ আনন্দ -উৎসবের পর কবুতররা বিদায় নিয়ে চলে গেল আর ইঁদুরও ঢুকে গেল গর্তে।

বন্ধুরা, গল্পের শুরুতেই আমরা কাকের কথা বলেছিলাম। ওই কাক কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এসব ঘটনা দেখছিল। সে এমনিতেই কবুতরদের একতা ও বুদ্ধি দেখে তাজ্জব বনে গিয়েছিল তারওপর ইঁদুরের কাণ্ড কারখানা দেখে তার বিস্ময়ের শেষ রইল না। তাই সে ইঁদুরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সিদ্ধান্ত নিল।

ইঁদুরের গর্তের কাছে গিয়ে সে নাম ধরে ইঁদুরকে ডাকতে লাগল। গর্ত থেকে বেরিয়ে আসার পর ইঁদুর তাকে ডাকার কারণ জানতে চাইল কাকের কাছে। কাক বলল: “কবুতরদের বিপদে তোমার বীরত্ব ও মহানুভবতা দেখলাম। বন্ধুর প্রতি তোমার দয়া দেখে আমি বুঝতে পারলাম যে, বন্ধুত্ব আসলে কি জিনিস। তাছাড়া একজোট হয়ে কাজ করলে কত বড় বড় বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় তা আজ আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে। তাই তোমার কাছে আমার একটিই অনুরোধ আমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ কর।”

ইঁদুর বলল : “সুন্দর সুন্দর কথা বলার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তবে একটা কথা জেনে রেখ, তোমার আর আমার মধ্যে বন্ধুত্ব হতে পারে না। কারণ ইঁদুর হচ্ছে কাকের খাদ্য, তাই কাক ইঁদুরের দুশমন। দুশমন কখনো বন্ধু হতে পারে না।”

কাক বলল: “তুমি ঠিকই বলেছো, কাকেরা হলো ইঁদুরের দুশমন। কিন্তু আমি তোমার আত্মত্যাগ, মহানুভবতা ও বিশ্বস্ততা দেখে তোমাকে অত্যন্ত ভালবেসে ফেলেছি।তবে আমি কথা দিচ্ছি, যারা তোমার শত্রু তাদের সঙ্গে আমি কোন সম্পর্ক রাখব না। আশা করি এবার আমাকে তুমি ফিরিয়ে দেবে না।”

ইঁদুর ও কাক এভাবে বহুক্ষণ ধরে কথাবার্তা বলল এবং বিভিন্ন কাহিনী ও উদাহরণ তুলে ধরল। এসব কথাবার্তা থেকে ইঁদুর বুঝতে পারল যে, কাক ঠিক কথাই বলছ। কাউকেই চিরদিনের জন্য শত্রু মনে করা ঠিক নয়। এরপর দু’জন মিলে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হলো এবং যে কোন বিপদাপদ একজোট হয়ে মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিল।

অভিশপ্ত মমির ভয়ানক কাহিনী !

ইসলাম অবমাননা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *