একটি আত্মা এবং অন্যান্য

ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজছে শ্রীকান্তের গান- মনের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে যার চোখে/ তাকে আর মনে পড়ে না। শ্রীকান্তের গানের মধ্যে কী যেন একটা যাদু আছে! এই গানগুলো অন্য শিল্পীরাও গেয়েছে কিন্তু তাদের কণ্ঠ এতোটা মাদকতা সৃষ্টি করতে পারেনি ভাবে দুলাল। দুলাল মাইক্রোবাসের ভিতরে বসে বসে গান শুনছে। আজ একটা ভাড়াও পায়নি। ওর সহকারী দশ বছরবয়সী লিটু জ্বরে আক্রান্ত বলে আজ আসতে পারেনি। লিটুর সঙ্গ সুপ্রসন্ন। লিটু আছে থেকেই প্রতিদিন তিন-চারটা ভাড়া জুটে যায়। আজ লিটু আসেনি বলেই কি ভাড়ার খরা? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মাঝবয়সী একটা লোক কাঁচের জানালায় মোবাইলের আলো ফেলে দুলালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জানালার কাঁচ নিচে নামিয়ে হাসি মুখে দুলাল সম্ভাষণ জানায় ভাবী কাস্টমারকে।

“আসসালামুআলাইকুম চাচা। গাড়ি লাগবে নাকি?” লোকটি সালাম নিয়ে বলে, “কালীগঞ্জ যাবেন?”

“কালীগঞ্জেই না গ্রামের ভিতরে?”

“একটু ভিতরে। গেলে বলেন।”

কালীগঞ্জ, সে তো এখান থেকে অর্থাৎ রংপুর মেডিকেল থেকে অনেক দূর। যেতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লাগবে। এখন বাজে রাত নয়টা। ফিরতে ফিরতে রাত তিনটা বেজে যাবে। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজি হয় দুলাল।

“ভাড়া সাড়ে তিন হাজার দেওয়া লাগবে।” দুলাল ভাড়া বলার মাধ্যমেই তার সম্মতি জ্ঞাপন করে।

“আনার সময় তো আড়াই হাজার দিয়া নিয়া আসছি। আজ দুপুরেই আনছি। এতো ভাড়া চাইলে কেমন করি হয়!”

কাস্টমারকে ফিরানোর কোনো ইচ্ছা নেই দুলালের। শেষ পর্যন্ত ঐ আড়াই হাজারেই থিতু হয় দুলালের চাহিদা। হাসপাতালের গেটের কাছে গাড়ি নিয়ে আসলে উপর থেকে স্ট্রেচার আসে। সঙ্গে আসা মহিলার বুকফাটা আর্তনাদ আর কান্নায় দুলাল বুঝে নেয় স্ট্রেচারে রোগী নয়, লাশ আর কান্নারত মহিলাটি- লাশটি এতোদিন পৃথিবীতে যে অস্তিত্ব নিয়ে ছিলো তার মা।

লাশটা গাড়িতে তোলার সময় দুলালও সাহায্য করে। ধরাধরি করার সময় ঢেকে রাখা মুখটা উন্মোচিত হলে দুলাল দেখতে পায় লাশের মুখের চারপাশে ফেনা। কী রকম একটা চেনা চেনা গন্ধ! কিশোরী মেয়েটি যে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে তা আর বুঝতে বাকি থাকে না দুলালের। মেয়েটির চোখ দুটো আধা খোলা। যেন চেয়ে চেয়ে দেখছে ওকে।

লাশের সহগামী চারজন। লালমনিরহাট পেরিয়ে, আদিতমারী পেরিয়ে কালীগঞ্জে মাইক্রোবাস এলে লাশ হওয়া কিশোরীর বোন জামাই পথ বাতলায়। ভিতরে আরো অনেক দূর আসতে হয়। নিতান্ত পল্লী এলাকা। কাঁচা রাস্তা। চারপাশে আবাদী জমি। বসত বাড়ির সংখ্যা কম। বিদ্যুৎ নেই। রাস্তাঘাটও সংকীর্ণ। তাই আস্তে আস্তে গাড়ি চালাতে হয়।

বারবার দুলাল জিজ্ঞাসা করে, “ভাই আর কতোদূর?” পথ প্রদর্শনকারী “এই তো আরেকটু সামনে” বলতে বলতে দুলালের মেজাজটা বিগড়িয়ে দেয় কিন্তু তা প্রকাশের কোনো সুযোগ পায় না সে। এমনিতেই মানুষগুলো শোকে আছে। কিশোরীর মায়ের কান্নার শব্দে কানে তালা লেগে গেছে ওর। মেয়ের ভাই দু’জন একবার “আম্মা কাঁদেন না তো” বললে মা চিৎকার করে ওঠে- “চুপ পাষাণের দল।”

ইতিমধ্যে বাড়ির লোকজন মোবাইলে খবর পেয়েছে। বিদ্যুৎ না আসলেও এসব এলাকায় মোবাইল ঠাঁই করে নিয়েছে স্থান। হ্যাজাক লাইট জ্বলছে দুইটা। অনেক লোকের সমাগম।

গাড়ি আসলে কান্নার শব্দ আরো তীব্র হতে থাকে। পাড়া প্রতিবেশিরা এসে কিশোরির প্রস্থানে তাদের হৃদয়ে কতোটুকু ব্যথা তা প্রদর্শনার্থে গলা জুড়ে দেয় পরিবারের অন্যান্যের সাথে। দু’একজন সান্ত¦না বাক্য শোনায়। কাঁদেন না। আল্লাহর নাম নেও। কলমা পড়ো। ভাড়া পাওয়ার জন্য বাইরে দেয়া একটা চেয়ারে বসে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় দুলালকে। গ্রামের মানুষদের টাকা-পয়সা সবসময় রেডি থাকে না তা জানে সে। তাই অপেক্ষা করতে কোনো সমস্যা নেই ওর। তাছাড়া এতোগুলো মানুষের কান্নায় ভারী হওয়া পরিবেশ ওর মনেও ব্যথার সৃষ্টি করে। কতোই বা বয়স হয়েছিলো মেয়েটির? পনের-ষোলোর বেশি নয়।

মেয়েটি কেনো আত্মহত্যা করলো তার কারণ প্রেমঘটিত কিছু, একপ্রকার ধারণা পোষণ করলেও নিশ্চিত হওয়ার জন্য পাশ দিয়ে যাওয়া একটা ছেলেকে ডেকে সে জিজ্ঞাসা করে। ছেলেটি জবাব না দিয়ে নীরবে চেয়ে থেকে ভিতরে চলে যায়। গাড়ি নিয়ে যখন সে রংপুর অভিমুখে রওনা হয় তখন রাত একটা। কাঁচা রাস্তাই পেরুতে হবে প্রায় দশ মাইল। কিছুদূর আসার পর একটা কান্নার শব্দ দুলালের কানে আসে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে কান্নার শব্দ। ছোট্ট মেয়েরা কোনো আবদার করে না পেলে যেমন নাকি সুরে কান্না জুড়ে দেয় তেমন। শব্দটা আসছে মাইক্রোবাসের পিছন থেকে। শরীরটা হিম হয়ে দুলালের। কান্নার সুর নাকি থেকে তীব্র হলে দুলাল গাড়িটা থামায়। গাড়ি ঐ বাড়িতে রাখার সময় ভিতরে কোনো বাচ্চা ঢুকে বসে আছে না তো?

দুলাল ভিতরের লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে পিছনের সিটগুলো উঁকি দিয়ে দেখে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কান্নার শব্দটা আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসে। বড় দোয়া পড়ে আল্লাহর নাম নিয়ে সে সাহস সঞ্চারের চেষ্টা করে। তারপর গাড়ি থেকে নেমে ব্যাকডালা খুলে চেক করতে ধরলে কানের পাশ দিয়ে শো শো করে কী যেন একটা চলে যায়! পাশ দিয়ে প্রচ- গতিতে কোনো গাড়ি গেলে যেমন মনে হয় তেমন। হঠাৎ গাড়ির লাইট বন্ধ হয়ে যায়। দুলাল যেন আর পৃথিবীতে নেই। সেই সাথে পিঠের মধ্যে একটা আঁচড় অনুভব করে সে।

মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখে একটা ডাল পড়ে আছে পায়ের কাছে। তারপর সে উপরের দিকে তাকায়। একটা বিরাট বড় বটের গাছ। এতোক্ষণ লক্ষ্যই করেনি সে। তখন বটগাছের মধ্যে ঝড় শুরু হয়ে যায়। তীব্র বাতাস। সেই সাথে কতোগুলো সম্মিলিত কণ্ঠের কান্না ভেসে আসে গাছটা থেকে। তখনই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় দুলাল। যখন জ্ঞান ফেরে তখন রাত দু’টা। বাতাস থেমে গেছে। মাইক্রোবাসের লাইটগুলো জ্বলছে। সে এবার উঠে দাঁড়ায়। আবার বুকে সাহস সঞ্চারের চেষ্টা করে। মরতেই যদি হয় তবে সাহস দেখিয়ে মরবে।

ব্যাকডালা লাগাতে গিয়ে একটা সাদা কাগজ চোখে পড়ে ওর। কাগজের ভিতরে কিছু একটা মোড়ানো আছে। দুলাল খুলে দেখে পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবি। সে ছবিটা ওর নিজের। এ ছবি এখানে এলো কী করে? এ ছবি তো সে তোলেনি কখনো! ছবিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে এবার জোরে গাড়ি টান দেয়। সারা রাস্তায় কান্নার আর কোনো শব্দ না পেয়ে আশ্বস্ত হয় সে। আকাশে যখন শুকতারা তখন সে রংপুরে পৌঁছে। কান্ত অবসন্ন শরীর আর বাধ মানতে চায় না। দু’চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে। গাড়িটা গ্যারেজে রেখে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ে সে।

ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখতে থাকে। এ এক আজব স্বপ্ন। কোনো দৃশ্য নেই শুধু শব্দ। সেই কান্নার শব্দ। এটা স্বপ্ন না বাস্তব- ভ্রম হয় দুলালের। দুলালের যখন ঘুম ভাঙ্গে ঘড়ির কাঁটা তখন দশটার ঘরে। ঘুমানোর পর শরীরের অবসাদ কেটে গেলেও জ্বর এসেছে প্রচ-। খাওয়া-দাওয়া সেরে সে সোজা চলে যায় কেরামতিয়া মসজিদে। দানবাক্সে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সে পীরের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে গতকালের সেই ভয়াবহ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ চায়। জ্বর শরীরে নিয়েই সে গাড়ি নিয়ে আসে মেডিকেলে। লিটুও এসেছে আজ। কাছাকাছি একটা ভাড়া খেটে এসে সন্ধ্যা নাগাদ আবার একটা ভাড়া পায়। নীলফামারির ভাড়া। দূরে হলেও লিটু থাকায় কোনো ভয় নেই আজ।

কিন্তু রোগী পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসার সময় ঐ কান্না আবার তার কানে বাজতে থাকে। এরপর হাসির শব্দ শুনতে পায়। হাসির কোমলতা লাঘব হয়ে তা ধীরে ধীরে হিংস্র আকার ধারণ করে। সে লিটুর কাছে জানতে চায় সে কোনো শব্দ পাচ্ছে কিনা। লিটু না-সূচক জবাব দিলে কথা বাড়িয়ে লিটুকে ভয় দেখাতে আগ্রহ পায় না সে। হাসির শব্দ কানে বাজতে থাকে। এ শব্দ বর্তমানে চলছে নাকি শ্রুতিভ্রম তা ঠাহর করতে পারে না দুলাল।

রাতে মেসে এসে ঘুমালে আবার সেই হাসির শব্দ সে শুনতে পায় ঘুমের মধ্যে, স্বপ্নে। এবার শুধু শব্দ নয়, দৃশ্যও দৃষ্টিগোচর হয়। সেই মেয়েটার মুখ। লাশটা গাড়িতে তোলার সময় কাপড় সরে গেলে যে মুখটা সে দেখতে পেয়েছিলো। মেয়েটা একবার হাসে, একবার কাঁদে। আসতে আসতে তার দিকে এগিয়ে আসে। খুব কষ্ট করে ঘুমটা ভাঙ্গাতে সমর্থ হয় দুলাল। সারারাত আর ঘুমাতে পারে না। পাছে আবার সেই মেয়েটি, মেয়েটির আত্মা তাকে আক্রমণ করে বসে।

অপমৃত্যু হলে সে আত্মা আত্মার জগতে ঠাঁই পায় না। ঘুরে বেড়ায়, মানুষের অনিষ্ট করে- এই গল্প সে ছোটবেলায় শুনেছে। মেয়েটির আত্মা কেন তাকে আক্রমণ করেছে তা সে বুঝে উঠতে পারে না। মন না চাইলেও চোখ দু’টি দুলালের জাগরণ মেনে নিতে পারে না। ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে সে। গভীর ঘুমের মধ্যে আবার মেয়েটির আত্মা সশরীরে ফিরে আসে। চড়ে বসে দুলালের বুকের উপর। দুলাল কিছুতেই ঘুম ভাঙ্গাতে পারে না।

মেয়েটি ছড়ানো এলোমেলো চুলের ভিতর থেকে তার মুখটা বের করে আনলে দুলালের পিলে চমকে যায়। মেয়েটির সামনের দাঁত দু’টো বের হয়ে আছে। চোখ কোটর থেকে ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইছে। দুলাল তখন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, কে তুমি? মেয়েটি উত্তর দেয়, ‘শয়তান আমাকে চিনতে পারিসনি তুই? আমাকে না চেনার ভান করছিস’ বলেই দুলালের গালে-মুখে কিল-ঘুষি দিতে থাকে।

কিন্তু কিল-ঘুষির শক্তি অতো তীব্র নয়। দুলাল এবার প্রশ্ন করে, এটা স্বপ্ন না বাস্তব?

এটাই স্বপ্ন, এটাই বাস্তব। মেয়েটি উত্তর দেয়।

আমার কাছে কেন এসেছো তুমি?

তোকে আমি মারতে এসেছিরে শয়তান। বলেই হাসতে থাকে মেয়েটি। সে হাসি বড় ভয়ংকর।

আমি কী ক্ষতি করেছি তোমার?

আমার মনের মানুষকে তুই হত্যা করেছিস?

আমি? না না। আমি কাউকে কোনোদিন হত্যা করি নি। দুলাল কথার খেই হারিয়ে ফেলে। ভেবে পায় না কখন সে কাকে হত্যা করেছে।

তুই করিস নি তোর জাত ভাইয়েরা করেছে। সে যখন বাসে রংপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছিলো তখন বাসের ড্রাইভার কথা বলছিলো মোবাইলে। একসময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস পড়ে যায় পাশের খাঁদে।

সেসহ আরো অনেক মানুষ মারা গেছে সেদিন। কী দোষ করেছিলো তারা? বল শয়তান বল। আবার কিল-ঘুষি মারতে থাকে মেয়েটি।

এক ড্রাইভারের কারণে তোমার মনের মানুষ মারা গেছে তার প্রতিশোধ নিচ্ছ আরেকজনের উপর? এ কেমন বিচার তোমার? দুলাল শান্ত করতে চায় মেয়েটিকে।
হ্যাঁ হ্যাঁ তোদের সবাইকে মারবো আমি। তাই তো আমি এপথ বেছে নিয়েছি। তোদের কাউকে বাঁচতে দেবো না।
তাহলে আমাকে মারছো না কেন?
কারণ তোর উপর আমার দয়া হচ্ছে।
দয়া? কীসের দয়া? অবাক হয় দুলাল।
কেননা তুই হচ্ছিস ওর মতো দেখতে। তাই আমি পারছি না। বলেই মেয়েটি এতোক্ষণ হাতের মুঠিতে ধরে রাখা দুলালের গেঞ্জির কলার ছেড়ে দেয়। যেন হাল ছেড়ে দিলো।

দুলাল এবার মনে করে সেই দিনের সেই ছবিটার কথা। যে ছবিটা ছিলো ঠিক তার মতোই। এরপর আরো অনেক কথা হয় দু’জনের। অনেক তথ্য পায় দুলাল। একসময় মেয়েটি একটা ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। বলে, তোকে আমি না পারছি মারতে, না পারছি ছাড়তে।
দুলালের ঘুম ভেঙ্গে যায় তখন। দেখে সে বিছানার নিচে পড়ে আছে। পুরো শরীর ঘেমে-নেয়ে গেছে। সকালবেলাই রহস্য উদঘাটনের জন্য দুলাল রওনা হয় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ছেলেটির গ্রামে। ছেলেটির নাম একবারো উচ্চারণ করে নি মেয়েটি। শুধু গ্রামের নামটা বলেছে। আর বলেছে যে ছেলেটি কারমাইকেল পড়তো। মেয়েটি পড়তো কাস টেনে।

দুলাল বুঝতে পারে খুব আবেগী ছিলো মেয়েটি। তা নাহলে এভাবে আত্মহত্যা করে কেউ প্রতিশোধ নিতে চায়? বাসে করে যায় দুলাল। ভোটমারিতে নেমে একটা রিকশা নিয়ে রওনা হয় চামটাহাটের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করবে কিছুদিন আগে যে ছেলেটা এক্সিডেন্টে মারা গেছে তার বাড়ি কোথায়? কাঁচা রাস্তা ধরে রিকশা চলছিলো। একজন মাঝবয়সী মানুষ সাইকেলে করে আসছিলো। দুলাল ভাবে লোকটাকে জিজ্ঞাসা করবে।

রিকশা কাছে আসতেই লোকটা দুলালকে দেখে সাইকেল থেকে নেমে দু’চোখ বিস্ফোরিত করে বলে, জামিল? দুলালের ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগে। সে বুঝতে পারে স্বপ্নটা সত্যি হলে এমনই হওয়ার কথা। সে রিকশা থেকে নেমে লোকটাকে বুঝানোর চেষ্টা করে। বলে যে, সে আসলে জামিল নয়। আরো সামনের দিকে যাওয়া নিরাপদ নয় জেনে সে লোকটাকে নিয়ে বিপরীত দিকে আসে। আলাপ শেষে দুলাল যা জানতে পারে তার সমীকরণ আরো জটিল। জামিলের বাবার সাত ছেলে। বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক। জামিলের বাবা তিন ছেলেকে দত্তক দিয়েছিলো। জামিল ছিলো জমজ। জমজের আরেকজনকে তার বাবা দত্তক দিয়েছিলো।

ব্যাপারটা বুঝতে দুলালের আরো কিছু সময় লাগে। দত্তক দিলে সাধারণত এমন পরিবারে দেয়া হয় যারা ভালোভাবে ভরণ-পোষণ দিতে পারে। তারা দত্তক সন্তানকে খুব আদরে রাখে। কিন্তু তার কপালে এমন হবে কেন? দুলালকেই পরিবারের জন্য আয় করতে হচ্ছে। অবশ্য পড়ালেখা করতে না পারার জন্য দুলালই দায়ী। এদিকে জামিল মারা-যাওয়ার পর তার পরিবারের সবাই হতাশ ও শোকগ্রস্থ। কেননা জামিলের উপরই পরিবারটি ভরসা করে ছিলো। জামিলের মেধা ভালো ছিলো। পড়ালেখা ছিলো শেষের দিকে।

দুলাল দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যায়। মেয়েটির আত্মাটিকে আর কতোদিন আশ্রয় দিতে হবে? কোনদিকে সে যাবে? আজ যা জানতে পারলো তাতে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। সে ভাবে একবার কী তার প্রকৃত বাবা-মাকে দেখে আসবে। নাকি গিয়ে বলবে, আমিই জামিল। আমি মারা যাই নি। তাহলে কেমন হবে ব্যাপারটা? পরক্ষণেই সে ভাবে কেন সে যাবে। তাকে তো ভরণ-পোষণ দেয় নি তার প্রকৃত বাবা-মা। যারা আদর-স্নেহ দিয়ে এতোদিন তাকে মানুষ করলো তাদের কী হবে? তাই সে ফিরতে চায় তার এতোদিনের স্থানেই।

কিন্তু তার পা দুটো ভারি হয়ে আসে।

একটা ভুতের গল্প

বামন ভূত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *