একজন মা হারা বীথি

আজ প্রথম দিন স্কুলে যাবে বীথি মায়ের সাথে । শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে সে । তার মতোই ছোট্ট একটা ইউনিফর্ম সেলাই করে এনে দিয়েছে তার মা । সেলাই করা ইউনিফর্ম ভর হতে না হতেই পরে নেয় বীথি ।

ভোর আসমান ছোঁয়া আনন্দের কারণে রাতে ভালো করে ঘুমই হয়নি কখন সকাল হবে,নতুন ইউনিফর্ম পরে মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাবে এই অপেক্ষায় । তাই সকাল হতে না হতেই তার মা ঘুম থেকে জাগার আগেই ছোট্ট বীথি রেডি হয়ে যায় স্কুলে যাওয়ার জন্য ।

-আম্মু স্কুলে যাবো তো চলনা । উঠোনা ।
-এখনো ঠিকভাবে সকালই তো হল নারে মা । স্কুল খুলেনি তো এখনো
-কখনো খুলবে বলনা । ( কাঁদো কাঁদো সুরে বলল বীথি )
-এইতো আর তিন ঘণ্টা পরেই । আমরা নাস্তা করবো, চা খাবো তারপর যাবো কেমন ?
-আচ্ছা আম্মু

বীথিরা ভাড়া বাসায় থাকে । ছোট্ট একটা বাসা । অনেকগুলো ছোট্ট বাসা একসাথে । সবার জন্য একটাই মাত্র চুলা । সকাল হতে না হতেই যে যার আগে পারে চুলার সামনে চলে আসে রাঁধতে । ছোট্ট রান্না ঘরটাতে চলে এক প্রতিযোগিতা । কার আগে কে রাঁধতে পারে ! ছোট্ট বীথিকে নিয়ে এই বাসাতেই থাকার সামর্থ্য আছে তার মা সাবিহার ।

বীথির বাবা বীথির জন্মের পরেই তাদের ছেড়ে চলে যায় । কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে সাবিহা সংসার ছাড়া হয় । ছোট্ট বীথিকে নিয়ে কষ্টের এতগুলো বছর পার করে দেয় সাবিহা । একটা অল্প বেতনের চাকরী নিয়েই বেশ চলে যাচ্ছে বীথিকে নিয়ে মা মেয়ের এই সংসার ।

সাবিহার চোখে স্বপ্ন । বীথিকে মানুষের মতো মানুষ করবে সাবিহা । সমাজকে দেখিয়ে দিবে মেয়েরাও পারে । মেয়ে সন্তানরাও পারে অনেক বড় হতে । বীথিকে ডাক্তার করতেই হবে । আর এর জন্য সাবিহার যত কষ্টই করতে হোক সে করবে ।

আজ থেকে বীথির লেখাপড়া শুরু হবে । আর একদিন দেখতে দেখতে বড় হবে বীথি । ডাক্তারি পড়বে । তার যত কাঁদতে হয়েছে জীবনে , যত কষ্ট পেতে হয়েছে তা তার মেয়ের আর পেতে হবেনা । এইসব ভাবতে ভাবতেই স্বপ্নের মধ্যে হারিয়ে যায় সাবিহা । তার ঘোর কাটে রহিমার মায়ের চিৎকারে –

-হায়রে হায়রে হায়রে পুড়ে ফেললো সব । কি রান্না করতে বসলি রে সাবিহা । সব তো পুড়ে ফেললি । মন কই তোর
-হায় হায় সব পুড়ে গেলো । আমার মেয়েটা আজ প্রথম স্কুলে যাবে । ভাবছিলাম হালুয়া রান্না করে খাইয়ে নিয়ে যাবো ওকে । তা আর হল না । আমার জীবনটাই তো পুড়া । আমার মেয়েটার জন্য হালুয়া রাঁধতে গেলাম তাও পোড়ে গেলো

সাবিহার চোখের কোণে পানি দেখা যায় । এই পানি হয়তো হালুয়া পোড়ার কষ্টের নয় । হয়তো পুরনো কষ্ট গুলোই এর কারণ । তার চোখের পানি দেখেই রহিমার মা সান্ত্বনা দেয় তাকে

আরে হালুয়া পোড়ার ছিল পুড়ে গেছে এর সাথে তোর কপালের কি দোষ । সব কিছুতে নিজের দোষ দিসনা তো । যা দোকান থেকে কিছু নাস্তা নিয়ে আয় । এগুলো খাইয়ে মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যা
-হ্যাঁ তাই করতে হবে । সময় নেই আর তেমন । যাই কিছু নাস্তা কিনে নিয়ে আসি

একশ টাকার নোট নিয়েই বেড়িয়ে পরে সাবিহা আশে পাশের দোকান গুলো বন্ধ । তাই একটু দূরেই যায় অন্য দোকানে । কেমন যেন এলাকা সব দিকেই বিল্ডিং নির্মাণের কাজ চলছে । মানুষ গুলো সব ব্যস্ত কাজে । উঁচু উঁচু বিল্ডিং । কাজ চলছে তো চলছে । সাবিহা একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকে ।

মেয়ের পছন্দের ৫ টা মিষ্টি আর কিছু নাস্তা নিয়েই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে । এই মিষ্টি পেয়ে তার মেয়ে কত খুশিটাই না হবে । মিষ্টি দেখে দৌড়ে এসেই তার মুখে চুমু দিবে, তাকে আদর করে করে বলবে আম্মু তুমি অনেক ভালো । এইসব ভেবেই একটু হেসেই রাস্তায় হাঁটতে থাকে সাবিহা ।

জামাল ইটে ভর্তি ঝুরি নিয়ে উঠতে থাকে বিল্ডিঙের সিঁড়ি দিয়ে । তার গায়ে জ্বর । মাথা ঘুরছে । মাথায় অনেকগুলো ইটে ভর্তি ঝুরি । ছয় তলার ছাদের কিনারায় এসেই মাথা ঘুরে পড়ে যায় জামাল সিঁড়িতে । আর উপর থেকে পড়তে থাকে সেই ইট সাবিহার মাথায় ।

কিছু বুঝে উঠার আগেই সাবিহা রাস্তায় পড়ে যায় । তার রক্তে লাল হয়ে যায় রাস্তা । দেহ থেকে প্রাণটাই চলে যায় তার তাও হাত থেকে মিষ্টির থলে পড়ে যায়না । এ যে তার মেয়ের জন্য মিষ্টি । তার মেয়ে স্কুলে যাবে ডাক্তার হবে । কিন্তু সেদিন সাবিহার সাথেই হারিয়ে যায় তার সব স্বপ্ন । তার সাথেই মাটি চাপা পড়ে যায় স্বপ্ন গুলোও ।

কয়েক মাস পর থেকেই বীথিকে দেখা যায় কখনো পার্কের পাশে কখনো বা কলেজের গেটে ছেলে মেয়েদের হাতে পায়ে ধরতে “আপা টাকা দেননা অনেকদিন কিছুই খাইনা আপা টাকা দেননা ” । একটু খাবারের জন্য বীথি পায়ে ধরে থাকে ছেলে মেয়েদের ।

মায়ের আদরের বীথির কপালে আজ কখনো বা খাবার জুটে কখনো বা জুটে কিল লাথি ধাক্কা

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!