আমার ছোটবেলার দুই বন্ধু পলাশ আর টমাস। টমাস নামটির পিছনে ছোট্ট একটি কাহিনী। ওর আসল নাম ছিলো টুটুল। বিজ্ঞানীদের মতো এই জিনিষ ওই জিনিষ নিয়ে গবেষণা করার কারণে আমাদের বন্ধু মহলে ও টমাস আলভা এডিসন নামে পরিচিত ছিলো। সংক্ষেপে টমাস নামেই ওকে ডাকা হতো। টমাস নামের আড়ালে ওর মায়ের শখ করে রাখা টুটুল নাম কোথায় যে হারিয়ে গেল, তা কেউ জানে না। এখন আর ও ছোটো নেই, বিয়ে-থা করে সংসার করছে। কিন্তু বন্ধুমহলে ওর নাম এখনো টমাসই রয়ে গেছে। ফিরে আসি মূল গল্পে। আমি, পলাশ ও টমাস এই তিনজন সবসময় একসাথে থাকতাম। পড়াশুনা, খেলাধুলা, দুষ্টামি সব কাজে তিনজন একজোট। আমাদের গ্রামে করিম চাচা নামে ধার্মিক লোক ছিলেন, উনার ছিলো বিশাল পেয়ারা বাগান।
আমরা প্রতিদিন করিম চাচার পেয়ারা বাগানের পাশের রাস্তা দিয়েই স্কুলে যেতাম। পেয়ারা বড় হয়ে টসটস করছে। তাই দেখে আমরা বেশ কষ্টে লোভ সামলাতাম। করিম চাচা সারাদিন বাসায়ই থাকতেন তাই বেড়া ডিঙ্গিয়ে তার বাগানে ঢুকে পেয়ারা চুরি করে খাবার চেষ্টা করা বৃথা। এভাবে বেশ কয়েকদিন গেলো। একদিন পলাশ আর সইতে না পেরে বলে বসলো, ‘পেয়ারা চুরি করতেই হবে যেভাবেই হোক’। আমি বললাম, ‘চুরি করার কি দরকার করিম চাচার কাছে গিয়ে যদি আমরা পেয়ারা চাই তাহলেই তো তিনি আমাদের পেয়ারা খেতে দিবেন। তিনি বেশ ভালো মানুষ, দু-চারটা পেয়ারা তো দিবেনই’। পলাশ বললো, ‘তা হয়তো দেবে। কিন্তু দেবে তো একদিন, প্রতিদিন তো আর দেবে না। আর চুরি করে কিছু খাবার যে মজা তা কি আর সেধে দিলে থাকে’।
আমি আর কিছু বললাম না। ভাবলাম চাচার এতবড় বাগান থেকে কিছু পেয়ারা আমরা খেলে তো আর তার তেমন কিছু আসবে যাবে না। বাদুরও তো কত ফল খেয়ে যায়, আমরাও নাহয় তেমনি কিছু খেলাম আরকি। সবাই মিলে বুদ্ধি করতে লাগলাম কিভাবে ও কখন পেয়ারা চুরি করা যায়। আমাদের বিজ্ঞানী টমাস মিয়ার মাথায় বুদ্ধির অভাব নেই তাই বুদ্ধিটা তার মাথা থেকেই আসলো। টমাস বললো, ‘করিম চাচা সব ওয়াক্তের নামাজ বাসায় পড়ে শুধু মাগরিবের নামাজ মসজিদে পড়ে। তাই ওই সময়েই চুরি করা সহজ হবে’। করিম চাচার বাসা থেকে মসজিদ বেশ দূরে তাই তিনি বাসাতেই নামাজ পড়তেন। আসরের পর হাটের দিকে যেতেন এবং আসার পথে মসজিদ ছিলো তাই মাগরিবের নামাজ পড়ে একেবারেই বাসায় আসতেন। আমরাও খেলাধুলা শেষে ঠিক ওই সময়েই মাঠ থেকে বাসায় ফিরতাম। তাই ঠিক করা হলো মাঠ থেকে ফেরার পথে করিম চাচার বাগানে হানা দিবো। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রতিদিনই চুরি করে পেয়ারা খেতে থাকলাম তিনজনে।
পাঁচ ছয়দিন পেয়ারা চুরি করার পর কিভাবে যেনো করিম চাচা টের পেয়ে গেলেন তার পেয়ারা চুরি যাচ্ছে। তাই সে একজন পাহারাদার রাখলেন। আমি বললাম, ‘এভাবে আর চুরি করা ঠিক হবে না। ধরা পড়লে চাচা আচ্ছা ধোলাই দিবেন’। ওরা কেউ আমার কথায় পাত্তা দিলো না। উল্টো আমাকে ভীতুর ডিম, কাপুরুষ ইত্যাদি আরো যা তা বলে আমাকে রেখে পেয়ারা চুরি করতে গেলো। সেদিন আর ওদের সাথে দেখা হয় নি। পরের দিন দুজনের কাউকেই স্কুলে আসতে না দেখে বুঝলাম কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। যা সন্দেহ করেছিলাম তাই সত্যি হলো কিনা তা ভেবে ভীত হয়ে উঠলাম। ওরা দুইজন কাজিন আর থাকেও একই বাড়িতে। ক্লাস শেষ করে, তড়িঘড়ি ছুটে গেলাম ওদের বাসায়। দেখি পলাশ আর টমাস একসাথে শুয়ে আছে আর দুজনেরই গায়ে জ্বর। বুঝলাম বেশ ভালোই মার পড়েছে পাহারাদার আর করিম চাচার হাতে।
পলাশের মা ওর মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে আর টমাসের মা টমাসের মাথায় পানি ঢালছে। আমাকে ঢুকতে দেখে আন্টিরা একবার তাকিয়ে আবার তাদের কাজে মন দিলো, কিছু বললো না। আমি গিয়ে ওদের কাছে গিয়ে বসতেই পলাশ আমার দিকে চোখ মেলে তাকালো এবং পলাশ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। ওর কান্না শুনে টমাস আমার দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। আমি বললাম, ‘আমি তোদের আগেই সাবধান করেছিলাম। তোরা আমার কথা শুনলি না উল্টো আমাকে গালমন্দ করলি। এমনি এমনি তো আর লোকে বলে না, চোরের দশদিন আর গেরস্তের একদিন’।