ইসলাম প্রচারের দ্বিতীয় পর্যায়

রিসালাতের মর্যাদায় ভূষিত হবার পরে তিন বছর পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অতি গোপনে আল্লাহর নির্দেশিত পথের দিকে মানুষকে আহ্বান জানাতে থাকেন। সত্যনিষ্ঠা, সত্যের অনুসন্ধিৎসা এবং ন্যায়ের প্রভাব ব্যতীত প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণকারী মুসলমানদের সামনে কোন প্রলোভন বা আকর্ষণ ছিল না। বরং প্রতি পদে পদে বিপদে পতিত হবার আশংকা ছিল।

এতদসত্ত্বেও এসব সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আহ্বানে সব কিছু হাসিমুখে বরণ করে নিতে সদা প্রস্তুত ছিলেন। এভাবে অপ্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের তিনটি বছর পার হয়ে গেল। অতঃপর আল্লাহ তাআলা প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত প্রদানের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি আয়াত নাযিল করেন। তদানুসারে তিনিও প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের জন্য কি পন্থা কি পদ্ধতি অবলম্বন করা যায় সে সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করতে লাগলেন।


তিন বছর পর্যন্ত সংগোপনে ইসলাম প্রচারের পর আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নির্দেশ দিলেন আপনি প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিন। সর্বাগ্রে আপনার নিকটাত্নীয়দেরকে ভয় দেখান। পথভ্রষ্ট মুশরিকরা যদি আপনার আনুগত্য না করে, আপনার অনুসরণে অনিহা প্রকাশ করে তা হলে আপনি মোটেও তাদের পরোয়া করবেন না। আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রকাশ্যে দাওয়াত প্রদানের সংকল্প গ্রহণ করেন। বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত ঘরে বসে চিন্তাভাবনা করতে থাকেন-কিভাবে স্বীয় নিকটাত্নীয়দেরকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান শুরু করবেন। আল্লাহর নির্দেশিত প্রকাশ্য দাওয়াতের বিষয়ে কি পদক্ষেপ নেয়া যায়, এটাই এখন তাঁর প্রধানতম ভাবনার বিষয়।


জীবন বৃত্তান্ত লেখকদের কারো কারো মতে, তাঁর গৃহবন্দী জীবনের খবর তাঁর চাচীসহ নিকটাত্নীয় মেয়ে মহলে পৌঁছে। হয় তো তিনি কোন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন, অথবা অন্য কোন মসিবতের সম্মুখীন হয়েছেন-এ আশংকায় নিকটাত্নীয় মহিলাদের সকলেই তাঁর খোজ খবর নেওয়ার জন্য আসেন।
তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর গৃহবন্দী জীবন এবং অন্যান্য অবস্থার সংবাদ অবহিত হন। জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন-আমি না কোন অসুবিধায় পড়েছি আর না কোন মসিবতে ঘিরেছি।

আসল ব্যাপার হল আল্লাহ পাক আমাকে নিকটাত্নীয়দেরকে ভয় দেখাতে এবং তাদের মাঝে দ্বীন প্রচার করতে আদেশ করেছেন। এখন আমি ভাবছি কি করব। ভাবছি তাদেরকে নিজ গৃহে ডেকে সে বিষয়ে ভয় প্রদর্শন করবো – যে বিষয়ে আমার রব আমাকে আদেশ করেছেন।


উপস্থিত মহিলাদের সকলেই বলেন- আপনার নিকটাত্নীয়দের সবাইকে ডাকুন। তবে আপনার চাচা আবদুল ওযযা আবূ লাহাবকে ডাকবেন না। কেননা, আপনি যা পছন্দ করেন সে তা কবূল করবে না।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় নিকটাত্নীয়দেরকে তাঁর ঘরে খাওয়ার দাওয়াত করেন। চাচী ও আত্নীয় মহিলাদের নিষেধ এবং আবূ লাহাবের মানসিক কাঠিন্য কঠোরতা সম্বন্ধে অবহিত থাকা সত্ত্বেও তাকে দাওয়াত দেন।
এই দাওয়াতে তাঁর চাচা-চাচীরা এবং অন্যান্য অনেক আত্নীয় স্বজন অংশগ্রহন করেন।

নবী করীম (সাঃ) উপস্থিত মেহমানদের আহারের পর তাদের সাথে সে বিষয়ে আলোচনা করবেন, যে বিষয় সম্বন্ধে আলোচনার উদ্দেশ্যে তাঁদেরকে এ মজলিসে আহ্বান করা হয়েছে এবং মহান আল্লাহও আদেশ করেছেন। আবূ লাহাব এই দাওয়াতকে তার অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মহাসুযোগ মনে করে বসে।

সে এ সময়টাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)- এর সাথে কথাবার্তা বলার এবং তাঁকে পিতৃপুরুষের ধর্ম পরিত্যাগ না করার উপদেশ প্রদানের মহাসুযোগ বলে গ্রহণ করে। সুতরাং আত্নীয় স্বজন সবাই উপস্থিত-এ মজলিসেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে পিতৃপুরুষের দ্বীন পরিত্যাগ করতে নিষেধ করার এবং বিরত রাখার যথার্থ সুযোগ মনে করে সে তা কাজে লাগানোর চেষ্টা করে।


আবূ লাহাব তাড়াতাড়ি কথার সুযোগ গ্রহণ করে বলতে শুরু করল, হে মুহাম্মদ! এখানে উপস্থিত উপবিষ্ট সবাই তোমার চাচা, চাচাত ভাই। সুতরাং এ মজলিসে তুমি সে কথাই আলোচনা কর যা এদের কাম্য। তুমি পিতৃপুরুষের দ্বীনের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ আরম্ভ করেছ তা হতে বিরত হও। আপন ভাই আত্নীয় স্বজনের জন্য তোমার চেয়ে কঠোর কঠিন মসিবত নিয়ে আর কেউ কোন দিন আগমন করেনি।

এ কথা ভালভাবে বুঝতে চেষ্টা কর যে, তোমার গোত্র সমগ্র আরবের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম নয়। তুমি তোমার বর্তমান অবস্থার উপর অটল থাক, তবে তোমার ভ্রাতৃবর্গ আত্নীয় স্বজনদের তোমাকে কয়েদ করা অন্যায় হবে না; বরং তখন তারা সত্য-ন্যায়ের পক্ষেই থাকবে। কুরাইশ তোমার উপর আক্রমণ পরিচালনা করলে অন্যান্য আরব গোত্রও কুরাইশের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করবে। কুরাইশ হামলা পরিচালনার পূর্বেই তোমাকে বন্দী করা উত্তম কাজ হবে।


রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দ্বীনে হক এবং তাদের বাতিল দ্বীন সম্পর্কে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন- কিন্তু আবূ লাহাব তাঁর কথার মাঝে উপস্থিত লোকদেরকে উত্তেজিত করে বলতে লাগল-
আল্লাহর কসম, এ খুবই মন্দ কাজ হবে যে, অন্যেরা তাকে কয়দ করবে। অন্যেরা কয়েদ করার আগে তোমাদেরই উচিত তাকে নিয়ন্ত্রণে আনা। তোমরা এ ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করলে এবং তাকে অন্যদের কাছে সমর্পণ করলে এ খুবই অপমানজনক হবে।

বর্তমানে তার যে চিন্তাধারা, এ অবস্থায় তোমরা তাকে রক্ষা করতে চাইলে আরবের লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। এ মজলিসে উপস্থিতদের মাঝে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) – এর ফুফু হযরত সফিয়াও ছিলেন। তিনি সামনে এগিয়ে আবূ লাহাবের প্রত্যুত্তরে বলেন-
ভাইজান! তোমার ভাতিজার অপমান অপদস্থা কি তোমার কাছে খুব ভাল লাগবে।


আল্লাহর কসম! আলেম সমাজ তো বহু পূর্ব থেকেই বলে আসছেন, আবদুল মুত্তালেবের বংশধারা হতে এক নবীর আগমন ঘটবে- মুহাম্মদই তো আলেমদের কথিত সেই নবী। আবূ লাহাব হযরত সফিয়ার কথা উপসাসচ্ছলে উড়িয়ে দিয়ে বলল- মেয়েরা ঘরে আর রান্নাঘরে বসে বসে এ ধরনের ভ্রান্ত চিন্তা এবং অযৌক্তিক আশা আকাঙ্খা লালন করে।

বল দেখি! যদি কোরাইশ আমাদের মুখোমুখি হয় এবং অন্যান্য আরব গোত্রসমূহও তাদের সাথে একাত্ততা ঘোষণা করে তবে কিভাবে আমরা তাদের মোকাবিলা করব? তাদের সম্মিলিত শক্তির সামনে তো আমরা এক মুষ্টিও হব না।

আবূ লাহাবের উপরোক্ত কথার জবাবে আবূ তালিব বলে উঠলেন আমরা যতক্ষণ বেঁচে থাকব-মুহাম্মদের সুরক্ষা করব।
আবূ তালিবের কথার জবাবে আবূ লাহাব সকলকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে আদেশ করে। এভাবেই আহূত প্রথম সভা ভেঙ্গে যায় এবং আগত লোকজন যার যার গৃহাভিমুখে প্রস্থান করে। মুহাম্মদ (সাঃ) স্বীয় উদ্দেশ্য অভ্যাগতদের সামনে উপস্থাপনই করতে পারলেন না।

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।