ইউশা বিন নূন (আঃ)

নাম ও নসবঃ হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) বনী ইসরাইল বংশোদ্ভূত। ঐতিহাসিকদের মতে তিনি হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর গোত্রের লোক। তাঁর পিতার নাম নূন এবং তাঁর পিতার নাম ফারাহীম। আর ফারাহীম হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর পুত্র। এর সাথে আমি অনেক দিন পর কথা বলে দেখতে পারি

নবুয়ত লাভ

মূসা (আঃ) বনী ইসরাইলীদেরকে নিয়ে যখন মিশর ত্যাগের নির্দেশ পেয়েছিলেন, তখন তাকে বলা হয়েছিল সিরিয়ার একটি এলাকা কেনানে পৌঁছার জন্য। কেননা, কেনানই ছিল বনী ইসরাইলের আদি আবাসভূমি। বনী ইসরাইলের ঊর্ধ্বতন পুরুষ হযরত ইয়াকুব (আঃ) কেনান থেকেই মিশরে আগমন করেছিলেন। আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ) কে যে পবিত্র ভূমির কর্তৃত্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা সিরিয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল। আর কেনান যেহেতু বৃহত্তর সিরিয়ারই একটি এলাকার নাম- তাই কেনানও পবিত্র ভূমিরই অন্তর্ভুক্ত।

মূসা (আঃ) বনী ইসরাইলীদেরকে নিয়ে সিরিয়া অভিমুখে রওয়ানা হন এবং আরিখা নামক স্থানে পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন। আরিখায় অবস্থান করে মূসা (আঃ) বনী ইসরাইলের বার গোত্রের বার জন প্রধান ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি গোয়েন্দা দল সেখানকার অধিবাসীদের খবরাখবর নেয়ার জন্য পাঠান। কেননা, কেনানসহ সমগ্র সিরিয়া ও তৎসংলগ্ন সকল অঞ্চল এক দুর্ধর্ষ পরাক্রমশালী সম্প্রদায়ের কবলে ছিল। এ সম্প্রদায়কে ইতিহাসে আমালিকা বলে উল্লেখ করেছে। যে প্রতিনিধি দল পাঠান হয়েছিল তাদের সাথে হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) ও ছিলেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যদের প্রতি নির্দেশ ছিল, তারা যেন অত্র স্থানের কোন তথ্য মূসা (আঃ) ছাড়া বনী ইসরাইলের আর কার নিকট প্রকাশ না করেন, কিন্তু মাত্র দুজনই এ নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করেন। এদেরই একজন ইউশা বিন নূন। অবশিষ্ট দশ জনই হযরত মূসা (আঃ) নির্দেশ উপেক্ষা করে সর্বসাধারণের নিকট গোপন তথ্য প্রকাশ করে দেয়। ফলে মূসা (আঃ) পূর্ব থেকে যা আশঙ্কা করেছিলেন, তাই বাস্তব হয়ে দেখা দেয়।

সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হতেই হযরত মূসা (আঃ) আশঙ্কাবোধ করছিলেন যে, কেনানসহ সমগ্র সিরিয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলই যে প্রবল পরাক্রান্ত দুর্ধর্ষ আমালিকা সম্প্রদায়ের দখলে তাদের দৈহিক শক্তিমত্তা, প্রকাণ্ড দেহবয়ব, যুদ্ধ কৌশল ইত্যাদি সম্পর্ক জেনে ফেললে বক্র, ভীত, ঐতিহ্যগত সন্দেহ প্রবণ বনী ইসরাইল সম্প্রদায়কে কিছুতেই তাদের সাথে জিহাদে অবতরণ করান যাবে না। বাস্তবে তাই ঘটল দশ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সদস্যের নিকট আমালিকা সম্প্রদায় সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর বনী ইসরাইলীদেরকে আমালিকা সম্প্রদায়ের সাথে জিহাদে অবতরণের আহবান জানান হলে তারা সে আহবান সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। তাদের সাফ

জবাব-প্রবল পরাক্রান্ত আমালিকা সম্প্রদায়ের সাথে সম্মুখ সমরে অবতরণ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সেখান থেকে বের না হবে, ততক্ষণ আমরা সেখানে প্রবেশ করব না। তারা মূসা (আঃ) -কে ছাপ ছাপ জানিয়ে দিল-আপনি এবং আপনার রব গিয়ে জিহাদ করুন। আমরা যেখানে আছি সেখানেই অবস্থান করব। হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) বনী ইসরাইলীদেরকে নানাভাবে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, তোমাদের কোন যুদ্ধই করতে হবে না। তোমরা কেবল আল্লাহ কর্তৃক তাঁর রাসূল মূসা (আঃ) -কে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির উপর পরিপূর্ণ আস্থা রেখে কেনানে ঢুকে পড়, দেখবে আল্লাহ তায়ালা প্রবল পরাক্রান্ত, মহাশক্তিধর আমালিকা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে বিজয় দান করবেন। কেনানসহ সমগ্র পবিত্র ভূমি তোমাদের দখলে চলে আসবে। কিন্তু তারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি আল্লাহর রাসূল মূসা (আঃ) ও রাসূলের প্রতিনিধি ইউশা বিন নূন (আঃ)-এর বার বার বুঝান সত্ত্বেও নিজেদের হঠকারী সিদ্ধান্তের উপরই স্থির থাকে। ফলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়ে হঠকারী বনী ইসরাইলীকে তীহ প্রান্তরে চল্লিশ বছর বন্দী জীবন কাটানোর শাস্তি দেন। তীহ প্রান্তরে বনী ইসরাইলী বন্দীদের সাথে হযরত মূসা (আঃ) হযরত হারুন (আঃ) এবং হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) ও অবস্থান করতে থাকেন। দুর্ভাগা বনী ইসরাইলের দেখাশোনা ও তত্ত্বাবধানের জন্য। হযরত মূসা (আঃ) হযরত খিজির (আঃ)-এর সাক্ষাত লাভের জন্য সফর কালে হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন। ইউশা বিন নূন (আঃ)-কে মূসা (আঃ)-এর ইন্তিকালের পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয়।

পবিত্র ভূমিতে গমন

হযরত মূসা (আঃ)-এর ওফাতের পর বনী ইসরাইল তীহ প্রান্তরের চল্লিশ বছরের বন্দী জীবনের অবসান হয়। তখন হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ)-কে নির্দেশ দেয়া হল। তিনি যেন আমালিকা সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ করে কেনান দখল করেন। বনী ইসরাইলীরা সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ)-এর আগমন করে। তাওরাতে উল্লেখ আছে, এ সময় তাদের সাথে আল্লাহ তায়ালার প্রতিশ্রুতির বাহক সিন্দুকটিও ছিল। এ সিন্দুকটি যাদের সাথে থাকবে, আল্লাহ তায়ালা তদেরকে বিজয় দান করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। হযরত মূসা (আঃ) লোহিত সাগর অতিক্রমকালে এ সিন্দুক তাঁর সাথে ছিল। বনী ইসরাইল বাহিনীর সাথে আরও ছিল হযরত মূসা (আঃ)-এর লাঠি, হযরত হারূন (আঃ)-এর জামাকাপড়সহ অন্যান্য বরকতময় দ্রব্যও।

হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) তাঁর বাহিনীর বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছুলে আমালিকা সম্প্রদায় এ সংবাদ অবগত হয়ে সার্বিক যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। উভয় দল মুখোমুখি হয়ে দিনব্যাপি পরস্পরের মধ্যেও তুমুল যুদ্ধ চলে। সন্ধ্যা সমাগত প্রায় কিন্তু যুদ্ধের ফলাফল কোন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করছে না। যদিও ময়দানে ইউশা বিন নূন (আঃ)-এর বাহিনী এগিয়ে রয়েছে। দিনটি ছিল শুক্রবার। তাওরাত কিতাবে শনিবারে ইবাদত ছাড়া সকল প্রকার যুদ্ধবিগ্রহ এবং জাগতিক সর্বপ্রকার কাজকর্ম নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। কাজেই আজই একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলে যুদ্ধ পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে মোড় নিতে পারে। অথচ সন্ধ্যা সমাগতপ্রায়। সামান্য কিছু সময়ের জন্য

চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে না। কাজেই আজকের সূর্যাস্তের পূর্বেই যুদ্ধের একটা চূড়ান্ত ফলাফল অর্জিত হওয়া প্রয়োজন। হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) আকাশের দিকে মুখ তুলে নিবেদন করলেন- হে আমাদের রব! সূর্য আপনার আদেশ অনুসারেই পরিচালিত হচ্ছে আমরাও আপনার আদেশেই জিহাদে অবতীর্ণ। সুতরাং আমাদের বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সূর্যের অস্তাগমন বিলম্বিত করুন। তাঁর এ দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। অবশেষে বনী ইসরাইলী বাহিনী জিহাদে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে।

যুদ্ধে জয়লাভের পর হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) বনী ইসরাইলকে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশের নির্দেশ দেন। তাদেরকে বলা হয়েছিল- বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশের সময় যেন তারা নিজেদের পূর্বের গুনাহসমূহের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও বনী ইসরাইলীরা স্বীয় স্বভাবগত বক্রতা আর হঠকারিতা থেকে দূরে থাকেনি। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, তারা যেন বায়তুল মুকাদ্দাসে ঢুকার সময় হিত্তাতুন (তওবা) বলতে বলতে আল্লাহর দরবারে নিজেদের অতীতের গুনাহসমূহের জন্য প্রার্থনারত অবস্থায় নতশিরে প্রবেশ করে। অথচ তারা আল্লাহর এ নির্দেশের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে শির উঁচু করে হিনতাতুন – (গমগম) বলে ব্যঙ্গ বিদ্রূপের সাথে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করে। প্রবেশের সময় পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-

وَإِذْ قُلْنَا ادْخُلُوا هَـٰذِهِ الْقَرْيَةَ فَكُلُوا مِنْهَا حَيْثُ شِئْتُمْ رَغَدًا وَادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّدًا وَقُولُوا حِطَّةٌ نَّغْفِرْ لَكُمْ خَطَايَاكُمْ ۚ وَسَنَزِيدُ الْمُحْسِنِينَ

فَبَدَّلَ الَّذِينَ ظَلَمُوا قَوْلًا غَيْرَ الَّذِي قِيلَ لَهُمْ فَأَنزَلْنَا عَلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا رِجْزًا مِّنَ السَّمَاءِ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ

অর্থঃ আর যখন আমি তাদেরকে বললাম, এ জনপদে প্রবেশ কর, অতঃপর তোমাদের যেখানে থেকে ইচ্ছা খাও আর যখন প্রবেশ করবে, নতশীরে তওবা বলতে থাক, তাহলে আমি তোমাদের অপরাধসমূহ মার্জনা করে দেব, আর আন্তরিকতার সাথে নেক আমলকারীকে আমি সত্বরই অধিক দান করব। অনন্তর জালেমরা সে কথা অন্য দ্বারা পরিবর্তন করে দিল, অতএব আমি তাদের প্রতি আসমান হতে আযাব নাজিল করলাম, কেননা, তারা হুকুম অমান্য করছিল। (সূরা বাকারাঃ আয়াত- ৫৮-৫৯)

হাদিসে আছে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার অপরাধে বনী ইসরাইলীরা প্লেগ মহামারিতে আক্রান্ত হয় এবং খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে সত্তর হাজার বনী ইসরাইলী মৃত্যু মুখে পতিত হয়।

হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) সাত বছর পর্যন্ত দ্বীন প্রচার অভিযানে সর্বমোট একত্রিশটি রাজ্য স্বীয় কর-কবলিত করলেন এবং রাজ্যগুলোর রাজাদের কতক মুসলমান হল এবং কতক হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে রাজ্য হারাল এবং প্রাণ বিসর্জনও দিল। বেলকায় অবস্থানকালে হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ)-এর কাছে খবর পৌঁছুল যে, সালেম পাহাড়ে যে সমস্ত

লোক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল, তারা দ্বীন ত্যাগ করে পুনরায় মূর্তিপূজা শুরু করে দিয়েছে। এ খবর শুনে তিনি তাদের সম্পর্কে আল্লাহর দরবারে হেদায়াতের প্রার্থনা করে বনী ইসরাইলীদেরকে নিয়ে মিশর চলে গেলেন এবং তাদের জন্য সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করলেন।

এ সময় হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ)-এর পার্থিব জীবনের শেষ লগ্ন ঘনিয়ে এসেছিল। তিনি তা বুঝতে পেরে সর্বপ্রধান সহচর হযরত কালুতকে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত করে আপন উম্মত বনী ইসরাইল এবং অন্যান্যদেরকে তার হস্তে হস্তে করে আল্লাহর সকাশে যাত্রা করলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল দুশবছর। কারও মতে তিনি ১৬৯ বছর আয়ু লাভ করেছিলেন।

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।