আমার কথাটি ফুরোলো–শেষ পর্ব

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সেদিনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষ হ’ল। লোকমুখে চারিদিকে রটে গেল, কে এক অজ্ঞাতকুলশীল অপরিচিত সুদর্শন যুবক রাজকুমারীকে ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতায় দারুনভাবে পরাস্ত করে দিয়েছে। ফলে পরের দিন লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতা দেখবার জন্য ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে দ্বিগুণ দর্শকের প্রচণ্ড জনতা সমবেত হ’ল।

বর্মচর্ম পরিহিত রাজকুমার ধনুর্বাণ নিয়ে আজ যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছিল সেখানে। রাজকন্যা আগের দিন ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে বেশ একটু লজ্জিত ও কুষ্ঠিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি একটু পরে প্রবেশ করে তার ধনুকে বাণ সংযোজন করে ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালেন।

ঘণ্টা পড়লো। মহারাজ ইঙ্গিত করলেন। লক্ষ্যভেদ করতে গিয়ে রাজকন্যার হাত যেন একটু কেঁপে উঠলো। রাজকুমারের ধনুকের নিক্ষিপ্ত তীর ততক্ষণে লক্ষ্য বিদ্ধ করে সেখানে যেন থর-থর করে আনন্দে কঁপিছিল। রাজকুমারীর নিক্ষিপ্ত শর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বেশ একটু তফাতে গিয়ে বিদ্ধ হ’ল।

লক্ষ লক্ষ জনতার কণ্ঠে আবার সেই বিপুল জয়ধ্বনি। তাদের সমবেত আনন্দ-কোলাহলের মধ্যে সকলের সঘন করতালি যেন কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। ‘জয়’ ‘জয় রবে চতুর্দিক মুখরিত হয়ে উঠলো।

রাজকন্যা আজকেও পরাজয় বরণ করে লজ্জায় মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইলেন। পরের দিন হাতের লেখা ও গণিতের পরীক্ষা। আজ রাজকুমারের মনটা একটু ভারাক্রান্ত ছিল।

কারণ, তার হস্তলিপি যে খুব ভালো নয় এটা তার জানা এবং অঙ্কের ব্যাপারেও সে যে খুব ওস্তাদ নয় এটা সে আগের রাত্রে অর্জুনের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে বেশ বুঝেছিল। তবু ভগবানকে স্মরণ করে সে এসেছে। যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে তাকে আজো জিতিয়ে দেয় এই ভরসায়।

সবাই উৎসুক হয়ে রাজকন্যার আগমন প্রতীক্ষা করছে। রাজকন্যার তখনো দেখা নেই। সময় প্রায় হয়ে এলো। শেষ ঘণ্টা পড়লো। রাজকুমারী কই?

এমন সময় দেখা গেল নববধূর বেশে সুসজ্জিতা হয়ে রাজকন্যা ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেন। সঙ্গে তার সখীরা নানা মাঙ্গলিক উপাচার হাতে নিয়ে পিছু-পিছু এলেন। পুরনারীরা হুলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি করছিলেন।

রাজকন্যা ধীরে-ধীরে রাজকুমারের নিকট এগিয়ে এসে রাজকুমারের গলায় নিজের কষ্ঠের বহুমূল্য বরণমাল্য খুলে পরিয়ে দিয়ে শ্রদ্ধাভরে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে উঠে সমবেত সকলকে সম্বোধন করে নমস্কার জানিয়ে বললেন, এই অজ্ঞাত বীরের কাছে বার বার পরাজয় স্বীকার করে আমি লজ্জিত হইনি।

আমি গর্বিত। আপনাদের সকলের সম্মুখে আমি সকল দেবতাকে আর আমার স্নেহময় পিতা মহারাজকে সাক্ষী রেখে এই বিজয়ী যুবককে আজ পতিত্বে বরণ করলাম। অন্য পরীক্ষা দুটি প্রত্যাহার করে নিলাম।

ক্রীড়া-প্রাঙ্গণের সেই বিরাট জনসমাবেশ তখন আনন্দ-কলেবরে চারিদিক যেন পূর্ণ করে তুললো। সারা প্রাসাদ যেন আনন্দ-উৎসবের হর্ষধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠলো। রাজা সিংহাসন থেকে নেমে এসে বর-বধূকে সাদরে আশীৰ্বাদ করে তাদের দু’জনকে পাশাপাশি বসিয়ে ঘোষণা করলেন, সাতদিন উৎসব হবে। আপনাদের সকলের নিমন্ত্রণ রইলো।

ইতিমধ্যে অর্জুন উর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে ইন্দিরাকে নিয়ে সেখানে হাজির হল।

বললো, বন্ধু, তোমার আদেশ পূর্ণ করেছি। রাজকুমার ইন্দিরা আর অর্জুনের পরিচয় করিয়ে দিলেন রাজার সঙ্গে।

ইন্দিরা ও রাজকুমার সেনাপতি সংগ্রামসিংহের পুত্র-কন্যা শুনে রাজার আর আনন্দ ধরে না। বললেন, আমরা ছিলাম বাল্যবন্ধু। তোমার পিতা আমাকে সাহায্য না করলে আমি আমার হৃতরাজ্য ফিরে পেতুম না। শ্রীভগবানের অশেষ দয়ায় আজ তোমাদের আমি কাছে পেলুম। আপনজন করে পেলুম।

তারপর? বিবাহ-সভায় সে রাত্রে শুধু রাজকুমারের সঙ্গে রাজকন্যারই বিবাহ হ’ল না, ইন্দিরার সঙ্গে অর্জুনেরও বিবাহ হ’ল রাজকুমারের ইচ্ছানুসারে।

মহারাজ রাজকুমারকে সে রাজ্যের যুবরাজ বলে ঘোষণা করলেন আর অর্জুনসিংহকে করে দিলেন তার প্রধান সেনাপতি। রাজ্য জুড়ে সাতদিন ধরে আনন্দ-উৎসব চলতে লাগলো।

আমার কথাটি ফুরোলো।

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!