গল্পের ষষ্ঠ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
রাঁধা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘরদোর ধোয়া-মোছা, আলো বাতি সাজানো, বিছানা করা, বিছানা তোলা, একে একে সব কাজই অন্নদা-মাসী তা ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন। নিজে আর কড়ার কুটোটা নাড়েন না। এদিকে পেটভরে খেতে দেন না ইন্দিরাকে। নিজের পুরোনো ছেড়া কাপড় তাকে পরতে দেন। ইন্দিরা অস্থির হয়ে উঠল।
সে তার দাদাকে গিয়ে সব কথা জানাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু বাড়ি থেকে বেরুবার সময় পায় কই ? মন্দির তো খুব কাছেই। সেখানে তার দাদা রয়েছে।
কিন্তু দাদা তো কই একদিনও এলো না তার খবর নিতে! দাদার বন্ধু সেই অৰ্জুন ছেলেটি এসেছিল বটে। বেশ ছেলেটি, খুব ভালো লেগেছিল তাকে ; কিন্তু সেও তো আর এল না।
একদিন ইন্দিরা মন্দিরে যাবার সুযোগ পেয়ে গেল।
ত্ৰৈলোক্যবাবু আর অন্নদা-মাসী সেদিন তাদের কোনো আত্মীয়ের বাড়ি নিমন্ত্রণে গেলেন। সারাদিন থাকবেন, সেই একেবারে রাত্রে ফিরবেন। ইন্দিরা ঠিক করলো আজ সে দাদার খবর নিতে মন্দিরে যাবেই। তাকে সব কথা জানিয়ে আসবে। এখানে সে আর একদিনও থাকতে পারছে না।
কিন্তু মন্দিরে গিয়ে ইন্দিরা পুরোহিত-ঠাকুরের কাছে শুনলো যে,
তার দাদা আর দাদার বন্ধু আজ রাজবাড়িতে গেছে এক প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে। রাজা রাজ্যে ঢেঁড়া পিটিয়ে দিয়েছিলেন রাজকুমারীকে যে ঘোড়দৌড়ে, লক্ষ্যভেদে, হাতের লেখায় আর অঙ্ক কষায় হারাতে পারবে রাজকুমারী তারই গলায় জয়মাল্য দিয়ে পতিত্বে বরণ করবেন।
আর দাদা সে ঘোষণা শুনে বন্ধুকে নিয়ে রাজবাড়িতে গেছে প্রতিযোগিতায় যোগ দেবার জন্য। কাল এই পরীক্ষা শুরু হবে। চারিদিকে হৈ-হৈ পড়ে গেছে। কিন্তু মা, আমার কি দুর্ভাবনা হয় জানো ?.রাজা ঘোষণায় বলেছেন, প্রতিযোগিতায় যে হেরে যাবে, তাকে যাবজজীবন কারাগারে বন্দী রাখা হবে। এসব জেনেও তোমার দাদা প্রতিযোগিতায় গেল!
শুনে ইন্দিরা চমকে উঠলো, কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললো, কী হবে ঠাকুর, দাদা যদি হেরে যায়! তারপর চোখ মুছে নিজেই বললো, নাঃ, দাদাই জিতবে। দাদা বীরপুরুষ।
পুরোহিত বললেন, মন্দিরে দেবতার কাছে ভয়ের জয় কামনা করে পুজো দিয়ে যাও। ভগবান যেন তার মঙ্গল করেন। –
আজ রাজকুমারী স্বয়ম্বর হবার জন্য প্রতিযোগিতায় নামবেন। রাজ্যের সবাই ভিড় করে এসে দাঁড়িয়েছে রাজপ্রসাদ-সংলগ্ন ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে। কোন ভাগ্যবান জয়ী হয়ে কন্ঠে রাজকন্যার বরণমাল্য পাবে অথবা পরাজিত হয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় যাবজীবনের জন্য কারাগারে নিক্ষিপ্ত হবে। উৎসুকচিত্তে নগর উজাড় করে যেন দর্শকরা এসে জমলো ক্রীড়া-প্রাঙ্গণে।
অৰ্জুন বললো, এমন দুঃসাহসিক প্রতিযোগিতায় তুমি যোগ দিও না।
পরাজয়ের সম্ভাবনাই বেশী। নইলে রাজকুমারী সদম্ভে এমন ঘোষণা করতে সাহসী হতেন না।
রাজকুমার বললো, যদি আমি হেরেই যাই তাহলেও বর্তমান অবস্থার চেয়ে ভালো থাকবো। দেবালয়ের নাটমন্দিরের দালানে ভিক্ষুকের মতো পড়ে থেকে দিনান্তে দুটি প্রসাদ পেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে আমি তো মনে করি রাজ-কারাগারে পরম সুখে থাকা যাবে।
বন্দী-জীবন আমাদের কার নয়, বলো? সবাই যে যার সংসার-শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে বন্দীর জীবনই যাপন করছি ; ওই যে পুরোহিত-ঠাকুর, উনিও তো ওই মন্দিরে দেবতার পুজোর শৃঙ্খলে বন্দী হয়ে রয়েছেন।