আমাদের পুরনো ছাদ

আমাদের বাড়িতে একটা মাত্র ঘর। সেই এক ঘরের বাড়িতে আমরা সবাই থাকি, খাই। এক ঘরের এই বাড়ির একটা দরজা, জানলা দুটো। একটাতে ভারী পর্দা ঝুলে আরেকটার কপাটে কালিমাখা। জানলাগুলো বন্ধই থাকে। তবু আমাদের একা রেখে বড়রা দূরে গেলে বারবার সেগুলোকে পরীক্ষা করে দেখা হয় বন্ধ আছে কিনা। তখন দরজা খোলাও বারণ। কারণ চোরের উপদ্রব খুব বেশি আর বাইরের ধু ধু মাঠে ঝড়ের হাওয়া ওঠে যখন তখন। সে ধুলোবালি ঘরে ঢুকে নোংরা করে দিতে পারে। আমরা ছোটরা চোর আর ধূলিঝড়ের ভয়ে জুবোথুবো হয়ে ঘরে বসে থাকি সে সময়। আমাদের একটা দুটো বই আছে।

বড়রা আমাদের সেগুলো পড়ে শোনায় দিনের বেলায়, যেদিন ওঁরা ঘরে থাকে। রাতে আলোর পর্যাপ্ততা থাকে না। দিনে ভারী পর্দার ফাঁক দিয়ে কিছুটা আলো ঘরে আসে, সে আলোতে আমাদের বই পড়তে দেয়া হয়। বইগুলোর নাম কিংবা এদের লেখকের নাম আমরা জানতে পারি নি কখনো। মলাটের ওপরে ধুলোর স্তর জমে গেছে, তাই নামগুলোও একেবারে ঝাপসা হয়ে গেছে। একবার জানতে চাইলে বড়রা একজনকে খুব শাস্তি দেয়। তাই আমরা আর কখনো ওসবের নাম জানতে চাই নি। আমরা বড় হবার অপেক্ষায় থাকি। এখন আমাদের উচ্চতা কম, ধীরে ধীরে আমরা লম্বা হব, বড়দের মত। আমরা মাঝে মাঝে এসব গল্প করি।

আমাদের বাড়ির ছাদটা খুব উঁচু নয়। সময়ের সাথে আমরা হিসেব করে দেখি আর কতদিন পর আমরা ছাদটাকে ছুঁতে পারব। কিন্তু কেউ কেউ বলে আমরা বড় হতে হতে আমাদের উচ্চতা বাড়বে কিন্তু আমরা ছাদ ছুঁতে পারব না। একজন জানতে চায়-কেন? আরেকজন বলে- তোমরা খেয়াল করে দেখোনি বড়রা ছাদ ছুঁতে পারে না। এর কারণটা জানতে চাইলে আমাদের মধ্যে একজন যে অন্যদের চেয়ে লম্বা আর বুদ্ধিমান সে বলে ওঠে- ওঁরা ছাদ ছুঁতে পারে না কারণ ওদের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে গেছে, ওঁরা কোমর ভাঁজ করে চলাফেরা করে। ওঁরা যদি সোজা হয়ে চলত তবে বাড়ির ছাদটা সারিয়ে নিতে হত, আরো উঁচু করে তৈরি করতে হত। আমরা বললাম- ছাদ কী করে উঁচু করা যায়, এ তো বদলানো যায় না! তখন সে বলল-নতুন করে তৈরি করা যায়।

বইতে লেখা আছে। আমরা অবাক হয়ে বললাম কোন বইতে এসব লেখা আছে? এসব কথা তো বড়রা আমাদের পড়ে শোনায় নি! সে চুপিচুপি বইটা বার করে সামনে মেলে ধরল। তারপর ভারী পর্দার জানালাটা খুলে দিল। হুড়মুড় করে আমাদের ঘরে আলো এসে পড়ল, অন্ধকারে অভ্যস্ত আমরা কিছুক্ষন অন্ধ হয়ে রইলাম, ভয় পেয়ে কেউ চিৎকার করে উঠল, কেউ জানালা বন্ধ করে দিতে চাইল। কিন্তু এর মধ্যে আমরা অবাক হয়ে দেখলাম একটা অচেনা নতুন বই। সবাই মিলে তার উপর হুমড়ি খেয়ে পরলাম। সেদিন অনেক নতুন কিছু জানলাম আমরা। কিন্তু বেশীক্ষণ এসব নিয়ে আলোচনার সুযোগ পেলাম না কারণ বড়রা ফিরে এল।

কয়েকজন ভুলে গেল নতুন বইটার কথা। রাতের বেলা নিচুস্বরে দিনেরবেলার কথাগুলো নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করল কেউ কেউ । দু’একজন বলল নতুন বইয়ের কথা বড়দের জানিয়ে দেবে, ওঁদের না জানিয়ে এসব করা মোটেও উচিত হচ্ছে না। এ কথা শুনে যারা আলাপ করছিল তারা ভয় পেয়ে চুপ হয়ে গেল। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। শুধু জেগে রইল একজন। তার মনে অনেক প্রশ্ন জমে গেছে। সে ঠিক করল সেগুলোর উত্তর খুব তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করবে। আর বাকিদের জানাবে। বড় হয়ে মেরুদণ্ড বাঁকা না করে এই বাড়িতে হাঁটা যাবে। কিভাবে নতুন করে ছাদটাকে উঁচু করা যায় সেটা সবাইকে শিখিয়ে দেবে।

বড়দের মত কোমর বাঁকা করে কেউ চলাফেরা করবে একদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে আমরা ছোটরা ওকে খুঁজে পেলাম না, যে আমাদের মধ্যে লম্বা আর বুদ্ধিমান ছিল, যে আমাদের নতুন কিছু কথা বলেছিল। আমরা ছোট তাই একদিন ভুলে গেলাম ওর কথা। তারপর আমরাও বড় হলাম। মাথার উপর পুরোনো ছাদটা এখনো রয়ে গেছে। আমরা কোমর বাঁকা করে হাঁটি। ছাদ ছোঁয়ার গল্প ভুলে গেছি আমরা। আমাদের ছোটরা ছাদ ছোঁয়ার গল্পই জানে না, কারণ ওরা সবাই বাঁকা মেরুদণ্ড নিয়ে কিংবা বামন হয়ে জন্মাচ্ছে। তাই আমরা আমাদের পুরনো ছাদটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগি না।

আরো পড়তে পারেন...

প্রতারণার কোয়ান্টাম মেথড

কয়েক মাস আগে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি মিলনায়তনের একটি অনুষ্ঠানের খবর আমরা জানতে পারি পরদিন প্রকাশিত দেশের…

সৌভাগ্যের ভেজাল চিঠি

কয়েকদিন আগে একটা চিঠি পেয়েছি, ডাকযোগে। টাইপ করা চিঠিটাতে কোন নাম ঠিকানা ছিল না, খামের…

বুনো রাজা ও রাজকুমারী– শ্রী ক্ষিতীশচন্দ্র কুশারী

এক বুনো রাজা। বনেই তাঁর রাজত্ব। যত অসভ্য জংলী তাঁর প্রজা। প্রজাদের ঘর নেই, দোর…