আমি মাথা নাড়লাম। আমার হাতের তালু ঘামছিল। এত শীতের মধ্যেও কন্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ। আমার জন্মপূর্ব বাংলার একটি মুসলিম পরিবারে। পারিবারিক ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে বড় হয়েছি। জিনের অস্তিত্ব যে অস্বীকার করিতাও না। কিন্তু, তাই বলে-… আমি আফসানাদের দিকে তাকালাম। ওরা তিনজনই এদিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওরাআমাদের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছে বলে মনে হল। আশ্চর্য! আফসানা ওর মাকে নীচু স্বরে কী যেন বলছে ।
উবাইদ মালিক বললেন, পবিত্র কোরআন মজীদে প্রায় ১২৮ বার শয়তান এবং জিনদের আলোচনা করা হয়েছে। সূরা তুর- এর ৫৬ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করছেন: আমি জিন ও মানবসম্প্রদায়কে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।
আমি খানিকটা অসহিষ্ণু কন্ঠে বললাম, এসব আমি জানি। কিন্তু, আমি … আমি আপনাকে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু … কিন্তু একজন ইনসান তো … মানে আমি … মানেমানুষ তো জিনদের মুলুকে এইভাবে যেতে পারে না।
উবাইদ মালিক মাথা নাড়লেন। চায়েরকাপে চুমুক দিলেন। তারপর কাপটা বেঞ্চির ওপর নামিয়ে রেখে বললেন, হ্যাঁ। আল্লাহতায়ালার হুকুমে জিনদের কিছু আলাদা কেরামত আছে বৈ কী । সূরা হিজর- এর ১২৭ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন: আমি ইতিপূর্বে জিনদেরতে অগ্নিশিখা হতে সৃষ্টি করেছি।
ভদ্রলোক কথাগুলি এমনভাবে বলছেন যেন ধর্মীয় মাহফিলে বক্তব্য রাখছেন। আমি অস্থির হয়ে বললাম, এসব আমি জানি। কিন্তু, আপনারা কিসত্যিই এই পৃথিবীতেই বাস করেন?
হ্যাঁ। আমাদের মতো আরও অনেকেই বাস করে।
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। দূর থেকে হুইশেলের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি ফাঁকা রেললাইনের দিকে তাকালাম। একটু পরই মাঝরাত্রির নির্জনতা খানখান করে ভেঙে দিয়ে একটি প্যাসেঞ্জারট্রেন এসে থামল। প্ল্যাটফর্মে খুব যে যাত্রী নামল তা কিন্তু নয়। উবাইদ মালিক আর তার পরিবার কে আমি আর দেখতে পেলাম না। কখন অদৃশ্য হল? উবাইদ মালিক রায়নগর যাবেন বলেছিলেন। তারা ঠিক ট্রেনেই উঠল কিনা তাও আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমার কেমন যেন ঘোর লেগেছিল। রাজারহাট স্টেশনের গার্ড আমার পরিচিত। সেএসে আমাকে বলল, স্যার, ট্রেন এসে গেছে। তার কথায় আমার ঘোর ভাঙল। চেয়ে দেখি-বেঞ্চির ওপর চায়ের কাপটা নেই! উবাইদ মালিক কি নিয়ে গেছেন? কখন নিলেন? এসব ভাববার সময় নেই। ট্রেনটা আবার হুইশেল দিয়েছে। এক্ষুনি ছাড়বে। আমি ঝুঁকে ব্রিফকেস তুলে নিয়ে দৌড়ে একটি কম্পার্টমেন্টে উঠলাম। কামরায় অবশ্য উবাইদ মালিক কিংবাতার পরিবারের কাউকে দেখতে পেলামনা। বলে রাবুমামা চুপ করে রইলেন।
এতক্ষণ রবিন, মুনিয়া আর নীলু গল্পটা রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল। মুনিয়া জিজ্ঞে করে, তারপর কি হল মামা?
তারপর? তারপর কুড়ি বছর কেটে গেল। রাজারহাট থেকে শ্যামগঞ্জ গিয়ে বছর কয়েক প্র্যাকটিস করলাম। তারপর কুসুমপুরে জমি কিনে এই বাড়িটা করলাম। তো, নাইনটিন এইটি ফাইভের কথা। একদিনরাতে ন’টার দিকে চেম্বার থেকে বাড়ি ফিরেছি । খেতে বসেছি। এমন সময় ফোন বাজল। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু শুভময় দস্তিদারের বড়ছেলে পল্লব কাঁদতে কাঁদতে ওর বাবার মৃত্যুসংবাদ জানাল। আমার মনটা গভীর বিষাদে ভরে উঠল। শুভময়ের বাড়ি ধনুদিয়া, কুসুমপুর স্টেশনের তিন স্টেশন পরেই । শেষবারের মতো বন্ধুকে একবার দেখার জন্য আমি ভীষণ অস্থির হয়ে উঠলাম । কোনওমতে নাকে-মুখে কিছুগুঁজে কুসুমপুর রেলস্টেশনের দিকে ছুটলাম। রেলস্টেশনে পৌছতে পৌছতে দশটা বাজল। রাতসাড়ে দশটায় ট্রেন। নভেম্বর মাস।স্টেশন নির্জন হয়ে ছিল। কুয়াশা ছড়ানো প্ল্যাটফর্মটি ফাঁকা। লোকজনের একেবারেই ভিড় ছিল না। ট্রেন আসতে দেরি হবে শুনে বিরক্ত হয়ে আমি প্ল্যাটফর্মের ওপর একটা ফাঁকা বেঞ্চিতে বসলাম।সামনে রেললাইনের ওপর কুয়াশা আর জ্যোত্স্না মিলেমিশে পড়ে আছে। শুভময়ের জন্য আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। এত বছরের সর্ম্পক। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। কবিতা লিখত।সেই কিনা শেষ পর্যন্ত ওকালতি পেশা বেছে নিল! তবে আপদ-বিপদ দৌড়ে আসত শুভময়; ওর সঙ্গে আমার কত স্মৃতি, আহ্, জীবন! বিষন্ন বোধকরছিলাম বলে একটা সিগারেট ধরিয়েছি … তখনই আমি ওদের দেখতে পেলাম। একটু দূরে একটি বেঞ্চিতে বোরখা পরা এক মহিলা আর সাফারি স্যুট পরা একজন পুরুষ বসে আছে । মধ্যবয়েসি পুরুষটি দীর্ঘদেহি এবং সুদর্শন। ধবধবে গায়ের রং। বোরখা পরা মহিলাটি পুরুষটির স্ত্রী কিনা তা ঠিক আমি বুঝতে পারলাম না। নেবাক পরা মহিলাটির ঠিক পাশে বেঞ্চির ওপর নীল রঙের বড় একটা ফ্লাক্স । দৃশ্যটায় কী যেন ছিল-আমি কিছুটা চমকে উঠলাম।বারবার ওদের দিকে তাকাচ্ছিলাম। একটু পর পুরুষটি উঠে কোথায় যেন গেল। হয়তো স্টেশন মাষ্টারের কাছে ট্রেনের খবর নিতে কিংবা টয়লেটে। পুরুষটি চলে যেতেই বোরখা পরা মহিলাটি ফ্লাক্স থেকেকাপে চা ঢেলে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসতে লাগল। আমি তো অবাক। মহিলাটি যখন আমার সামনে এসে দাঁড়াল, ঠিক তখুনি আমি মিষ্টি একটা গন্ধ পেলাম; অনেকটা হাসনাহেনার গন্ধের মতন। কি ব্যাপার? মহিলাটি আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কেন? মহিলার হাতে চায়ের কাপই বা কেন? ওকি আমাকে চেনে?
গল্পের শেষ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।