অযাত্রা–দিবাকর ভট্টাচার্য শেষ পর্ব

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

‘এখন শান্তি’—কথাটা সিদ্ধার্থের কানে এসে বাজবে অদ্ভুতভাবে। তখনই সিদ্ধার্থ মুখটা ঘুরিয়ে তাকাবেন দূরের ওই বেঞ্চিটির দিকে। তারপর চায়ের ভাঁড়টি হাতে নিয়ে ফিরে আসবেন ওই বেঞ্চিটায়। ভাঁড়ে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে টানটান হয়ে বসবেন ওখানে। ঘাড় উঁচু করে তাকাবেন সামনের দিকে। তারপর ডাইনে, বাঁয়ে এবং আবার সামনের দিকে।

তখন সিদ্ধার্থের চোখের সামনে থাকবে প্ল্যাটফর্মের ওপারের একসার টালির ঘর। মাঝে মধ্যে দু একটা রাধাচূড়া গাছের মাথা। তার পিছনে চাপ চাপ কুয়াশায় ঢাকা ঘোলাটে সূর্য।

এইভাবে ভোর আসবে ওই অখ্যাত স্টেশনের উপর। আর সিদ্ধার্থ কেমন যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবেন ওই সবকিছুর দিকে।

তখন—ঠিক তখন সিদ্ধার্থের মনে হবে—ওই দূরের গাছের পাতার মধ্যে সূর্যটা যেন কমলা রঙের টিপের মতো আটকে রয়েছে—গাছের শুকনো কোঁকড়ানো পাতাগুলো ভোরের নরম হলুদ আলোয় যেন সোনার পাতের মতো ঝরে পড়ছে—দূরের টালির ঘরের লালচে মাথাগুলো সদ্য-আঁকা ছবির মতো জ্বলজ্বল করছে। এই সবকিছুর উপর ‘এখন শান্তি’ কথাটা যেন মসৃণভাবে বিছানো রয়েছে।

নিজের অজান্তেই চায়ের ভাঁড়ে বেশ লম্বা করে একটা চুমুক দিয়ে ফেলবেন সিদ্ধার্থ। আর বলে উঠবেন—’আঃ।’ তাঁর ঠোঁটে জিভে মুখে ঘন হয়ে লেগে থাকবে এক তৃপ্তির আস্বাদ। আর তখনই হঠাৎ তিনি বুঝতে পারবেন গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে থাকা সেই অস্বস্তিটা আর নেই।

আর সেই সময়েই গত রাতের আটকে যাওয়া ট্রেনটা ঝমঝম আওয়াজ করে ঢুকে পড়বে স্টেশনের ওই প্ল্যাটফর্মে। কোত্থেকে কয়েকটা লোক দুদ্দাড় করে এসে হাজির হবে ট্রেনের সামনে। আর ঝপাঝপ উঠে পড়বে ওই ট্রেনে। আর সিদ্ধার্থ?

সিদ্ধার্থ তখনও ভাবতে থাকবেন এতদিনের ওই অস্বস্তিটা হঠাৎ কিভাবে উধাও হয়ে গেল। আবার বড়ো চায়ে চুমুক দেবেন তিনি। বারবার ঢোঁক গিলে দেখবেন গলার চাপচাপ ভাবটা ফিরে আসছে কিনা। কিন্তু নাহ্‌। অস্বস্তিটা আর নেই। নিশ্চিতভাবেই।

ঠিক তখনই যেন সিদ্ধার্থ শুনতে পাবেন সেই পরিচিত স্বর—’চমৎকার—ভারী চমৎকার—আজকের সকালটা—কি বলেন?’

মনে হবে কথাগুলি যেন ভেসে আসছে তাঁর বাঁ পাশ থেকে। শুনে চমকে উঠবেন তিনি। চেষ্টা করবেন বাঁ দিকে তাকাতে—আড়ষ্টভাবে। ততক্ষণে হুসহাস শব্দ করে ট্রেনটা বেরিয়ে যাবে প্ল্যাটফর্ম থেকে। সিদ্ধার্থ দেখবেন—নাহ্‌। কেউ নেই তাঁর পাশে বসে।

তাহলে?

আবার মনের ভুল?

এর মাঝে সিদ্ধার্থের ট্রেনটা মিস্‌ হয়ে যাবে আবার।

সকালবেলা।

একটি অখ্যাত স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম।

প্ল্যাটফর্মে একটিমাত্র বেঞ্চ।

আর সেই বেঞ্চে বসে আছেন একটি হৃষ্টপুষ্ট ফিটফাট ব্যক্তি। প্ল্যাটফর্মে এদিক ওদিক যাতায়াত করছে দুচারটি লোক। এই লোকটিকে দেখে মনে হয় তিনি বসে আছেন নিশ্চিন্ত হয়ে।

হয়তো ভাবছেন—

—আজ সকালটা বেশ সুন্দর।

—আরেক ভাঁড় চা নিয়ে আসি।

—আর দুটো বিস্কুট।

—অনেক ভোগান্তি গেল।

—অযথা।

(কাহিনীটির প্রথমাংশ বিখ্যাত নাট্যকার লুইজি পিরানদেলোর দ্য ম্যান উইথ দ্য ফ্লাওয়ার ইন হিজ্‌ মাউথঅনুসরণে)

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!