অযাত্রা–দিবাকর ভট্টাচার্য চতুর্থ পর্ব

গল্পের শেষ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সিদ্ধার্থ ভাববেন কি হবে সেখানে গিয়ে। তার চেয়ে ট্রেনে থাকাই ভালো। সেই ভেবে সটান শুয়ে পড়বেন চাদর মুড়ি দিয়ে। কিন্তু একটু পরেই সেই বেয়াড়া অস্বস্তিটা ঘিরে ধরবে সিদ্ধার্থকে। আবার মনে হবে গলার কাছে কি একটা দলা পাকিয়ে শ্বাসটা আটকে দিচ্ছে তার। অনেক কষ্টে যে অস্বস্তিটাকে দাবিয়ে রেখেছেন তিনি ইদানীংকালে, সেটা আবার এই সময় মাথা চাড়া দেবে।

‘নাহ্‌। এর চেয়ে ট্রেনের বাইরে যাওয়াই ভালো। হোক্‌গে অজানা অচেনা বনবাদাড়। কিন্তু খোলা আকাশের নীচে তো হবে’—এই ভাবতে ভাবতে ট্রেন থেকে নেমে পড়বেন সিদ্ধার্থ। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবেন নেমে পড়া আরো কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে। ওই স্টেশনের দিকে।

কিন্তু আরেকটু এগোতেই সিদ্ধার্থ বুঝতে পারবেন যে ওটি সেই স্টেশন যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার সেই বিশ্রী অভিজ্ঞতা। অর্থাৎ সেই ভাঙা রেলিং সেই টিমটিমে আলো—আর সেই বেঞ্চ!

শীতের রাত থমথম করবে সর্বত্র। সঙ্গের লোকগুলো সব কোথায় চলে যাবে কে জানে। সিদ্ধার্থ সেই প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াবেন। বলা যায় দাঁড়াতে বাধ্য হবেন। শরীরটা কেমন ঝিমঝিম করতে থাকবে তাঁর। তিনি বুঝতে পারবেন এই অবস্থায় অন্ধকারে রাস্তা চিনে ওই ট্রেনের কামরায় ফেরৎ যাওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব। তাই সিদ্ধার্থ অসহায়ের মতো বসে পড়বেন প্ল্যাটফর্মের সেই বেঞ্চিটিতে। ওই টিমটিমে আলোর নীচে। ওই ভাঙাচোরা রেলিঙের সামনে।

আর তখন ভাবতে থাকবেন—এইবার-এইবার আবার এসে হাজির হবে সেই বীভৎস মুখটা—পাশে এসে ফিসফিসিয়ে বলবে—’ভালো থাকবেন – খুব ভালো থাকবেন।’—আর তখনই যেন গলা বন্ধ হয়ে শ্বাস আটকে আসবে তাঁর।

তাই প্রতিটি মুহূর্তেই সিদ্ধার্থের মনে হবে সময়টা যেন নড়তে চাইছে না কিছুতেই। অথচ তাকে বসে থাকতেই হবে সেই দিনের আলো ফোটা পর্যন্ত। আর এর মধ্যে যে কোনো সময়ে তাঁর সামনে ঠোঁট উলটে এসে হাজির হতে পারে সেই ‘এপিথেলিওমা’! তাহলে?

তাহলে সে চিৎকার করে বলতে বাধ্য হবে—’যান তো মশাই – যান তো আমার সামনে থেকে’। কিংবা একটা ঘুষিতে ফাটিয়ে দেবে লোকটার মুখটা। অথবা লোকটার হাত দুটো ধরে বলবে—’প্লীজ! প্লীজ। আমায় একটু একা থাকতে দিন’।

তারপর সিদ্ধার্থের মনে হবে—এই ক’মাসে লোকটি নিশ্চয়ই আরো অসুস্থ হয়ে যাবে—আঙুরের সাইজের টিউমারটা নিশ্চয়ই আরো বড়ো হয়ে যাবে—তাহলে—তাহলে তো সেটা আর ঠোঁটের আড়ালে লুকিয়ে থাকবে না—হয়তো মুখের বাইরে বেরিয়ে এসে ঝুলবে বীভৎসভাবে।

এইসব ভাবতে ভাবতে সিদ্ধার্থ চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকবেন ঠিক মড়ার মতো।

কিন্তু নাহ্‌। কেউ এসে বসবে না সিদ্ধার্থের পাশে। কেউ এসে বলবে না—’ভালো থাকবেন। সব্বাই ভালো থাকবেন’। বরং খানিক বাদে সিদ্ধার্থ হঠাৎ শুনতে পাবেন একটি পাখির ডাক। তারপর আরো কয়েকটির। বুঝবেন ভোর হচ্ছে। তখন ভয়ে ভয়ে চোখ খুলবেন তিনি। অতি সন্তর্পণে তাকাবেন এদিক ওদিক। এবং নিশ্চিত হবেন যে কেউ নেই। কেউ কোত্থাও নেই।

একটু দূরে ওই স্টেশন চত্বরেই একটা চায়ের দোকান দেখতে পাবেন। সিদ্ধার্থ পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবেন সেইদিকে। এক মহিলার দোকান। সদ্য জ্বলে ওঠা উনুনের আঁচ ধাপে ধাপে উঠছে উপরের দিকে। সিদ্ধার্থ সেই আঁচের সামনে এসে দাঁড়াবেন। বলবেন—’একটা চা।’ সিদ্ধার্থ টের পাবেন তাঁর গলাটা আবার বুজে আসছে ক্রমশ। তাই কোনোক্রমে এক ভাঁড় চায়ে গলা ভিজিয়ে বিদেয় হতে চাইবেন এই বিশ্রী জায়গা থেকে।

চায়ের ভাঁড় মুখে নিয়ে দোকানের ভিতরে তাকাতেই দেখতে পাবেন সেই মুখটি! সেই চোখ! আর সেই দৃষ্টি! কিন্তু ফ্রেমে বাঁধানো। চন্দনের ফোঁটা দেওয়া। উনুনের ধোঁয়ার পিছনে কেঁপে কেঁপে উঠছে। সিদ্ধার্থ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবেন সেই ছবিটির দিকে। শুনতে পাবেন ওই মহিলার কণ্ঠস্বর—’আমার স্বামী। গতমাসে চলে গেছে। চিনতেন নাকি?’ সিদ্ধার্থ কোনোক্রমে উত্তর দেবেন—’হুঁ’। ফুটন্ত জলের শোঁ শোঁ আওয়াজে সেই উত্তর বোধহয় মহিলার কানেই যাবে না। শীর্ণ হাতে চা ঢালতে ঢালতে তিনি নিজের মনেই বলে যাবেন—’খুব কষ্ট পাচ্ছিল—যন্ত্রণা হোতো—রক্ত বেরোতো গলগল করে’। তারপর একটু থেমে যেন চোখ মুছতে মুছতে বলবেন—’এখন ওর আর কোনো কষ্ট নেই—এখন শান্তি।’

 

গল্পের শেষ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!