অযাত্রা–দিবাকর ভট্টাচার্য ২য় পর্ব

গল্পের ৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

হতে হবে না (একটু থেমে) ও আমায় বড়ো ভালোবাসে জানেন ওর ইচ্ছে যে ও আমার সঙ্গেই মরবে (আবার একটু থেমে) পাগলী একটা—সারা দিন কিছু খায় না—ঘুমোয় না—এই করে চেহারাটা হয়েছে যেন সত্তর বছরের বুড়ি—অথচ ওর বয়স কতো জানেন—মাত্র পঁয়ত্রিশ (আবার একটু থেমে) কিন্তু আপনি ওরকমভাবে সিঁটকে বসে আছেন কেন মশাই? এখনো ভাবছেন নাকি আমি যদি এই পায়ের নীচ থেকে একটা আধলা ইঁট তুলে চাপিয়ে দিই আপনার মাথায়— (একটু হেসে) আরে না না অত ভয় পেলে হবে? বাড়ি যেতে হবে না? বাড়িতে আপনার স্ত্রী অপেক্ষা করে আছে (একটু থেমে) আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আপনার ঘরের কোণে ডোকরার দুর্গা মূর্তিটি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখছেন আপনার স্ত্রী—তার সামনে একটা ছোটো কাঁচের টেবিল—একটা সাদা পাথরের বাটিতে জল দিয়ে উনি ভাসিয়ে দিচ্ছেন কতগুলি হলুদ রঙের ফুল—আর আপনি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন সেই ফুলগুলির দিকে।
(সিদ্ধার্থ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন অপরিচিতের মুখের দিকে, আর অপরিচিত ব্যক্তিটি সিদ্ধার্থের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে যান—) হ্যাঁ, সত্যি বলছি—আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি (এইবার একটু থেমে খুব আস্তে করে বলে ওঠেন) আপনি তখন একটা কাজ করবেন প্লিজ? আমার হয়ে একটা কাজ করবেন? আপনার স্ত্রীকে বলবেন একটু বেশি করে ফুল সাজিয়ে দিতে—(সিদ্ধার্থ অবাক হয়েই তাকিয়ে থাকেন তাঁর দিকে; একইভাবে অপরিচিত ব্যক্তিটি বলে যান) গুনে দেখবেন তো ভালো করে গুনে দেখবেন তো কটা ফুল ভাসছে ওই পাথরের বাটিতে—ঠিক করে গুনবেন কিন্তু কারণ যে কটা ফুল ভাসবে সে কটা মাসই বোধহয় আমার আয়ু—
(এই কথার মাঝে দূর থেকে ট্রেনের আওয়াজ শোনা যাবে—অপরিচিত ব্যক্তিটি বলে উঠবেন) আরে ওই ট্রেন এসে গেল আপনারা রেডি হোন রেডি হোন আর মিস করবেন না। (ট্রেনের আওয়াজ ক্রমশ বাড়তে থাকবে) যান যান সাবধানে বাড়ি যান—আর ভালো থাকবেন খুব ভালো থাকবেন ফূর্তিতে থাকবেন খুশিতে থাকবেন স্ত্রীর সঙ্গে পরিবারের সঙ্গে। বলতে বলতে অন্ধকারে কোথায় যেন চলে গেলেন লোকটি।

সিদ্ধার্থ হতবাক হয়ে লোকটির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। কারণ তখনই ঝমঝমিয়ে ট্রেনটা ঢুকে পড়লো স্টেশনে।

‘এবার মিস করলে চলবে না’—ভাবতে ভাবতে হুড়মুড় করে প্রায় ফাঁকা ট্রেনের কামরাতেই উঠে বসলেন সিদ্ধার্থ। বসলেন জানালার ধারে। ফাঁকা জায়গায়। বসতে না বসতেই চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো তাঁর। সেই ঘুমের ঘোরেই তাঁর চোখের সামনে ভাসতে থাকলো সেই টকটকে লাল ফুলের মতো ‘এপিথেলিওমা’।

তখনই মনে হোলো সিদ্ধার্থের কেউ যেন গলাটা চেপে ধরেছে। ঢোঁক গিলতে আর শ্বাস নিতে কেমন একটা কষ্ট হচ্ছে। বাকি রাতটা জেগেই কাটালেন সিদ্ধার্থ। দম আটকানোর আতঙ্কে আর গলার ওই অস্বস্তিটাকে নিয়ে।

তারপর?

তারপর সিদ্ধার্থ বাড়ি পৌঁছোবেন। পরের দিন সকালে। একটু দেরিতে। বাড়ি ফিরতেই শুরু হবে তাঁর স্ত্রীর যথারীতি হৈ হৈ। তারপর প্যাকেট খুলে জিনিসপত্র বের করা। আর সেই নিয়ে আরেক দফা ধিন্‌ ধিনা ধিন্‌। সিদ্ধার্থের মাথাটা দপ্‌ দপ্‌ করতে থাকবে যন্ত্রণায়। সিদ্ধার্থ বাথরুমে যাবেন। বাথরুমে ঢুকতেই হুড় হুড় করে বমি হয়ে বেরিয়ে যাবে গতরাতের হজম না হওয়া সমস্ত খাবার। চোখেমুখে জল দিয়ে ভালো করে মুখ কুলকুচি করবেন সিদ্ধার্থ। মনে হবে গলার অস্বস্তিটা যেন কিছুতেই যাচ্ছে না। এই সঙ্গে মুখে এসে জুটেছে কেমন একটা বিস্বাদ ভাব। ‘জর্দা পানটা ছেড়ে দেবো কাল থেকে’—ভাবতে ভাবতে পায়ে জল ঢালতে থাকবেন তিনি।

এরপর নিয়মমাফিক খাওয়ার টেবিলে এসে বসবেন সিদ্ধার্থ। কিন্তু কিছুই খেতে ইচ্ছে করবে না তাঁর। খুব সামান্য একটু ভাত মুখে নেবেন। সেই মতো অতি অল্প একটু তরকারি। সিদ্ধার্থের স্ত্রী জিজ্ঞাসা করবেন—’কি হোলো শরীর খারাপ নাকি?’ ‘নাহ্‌। তেমন কিছু নয়’—বলে সিদ্ধার্থ উঠে পড়বেন খাওয়ার টেবিল থেকে। তারপর শোয়ার ঘরে এসে বিছানায় শরীরটা ফেলে দেবেন কোনোক্রমে। হাত বাড়িয়ে জ্বালাবেন বিছানার পাশে ছোট্ট কাঁচের টেবিলে রাখা বাহারী ল্যাম্পটাকে। হাল্কা হলুদ আলো গোল হয়ে নেমে আসবে তাঁর বিছানার পাশে। আর ঠিক তখনই তাঁর চোখে ভেসে উঠবে একটি টিমটিমে আলো। আর সেই আলোর পিছনে ঘোলাটে অন্ধকার। সেই আধো অন্ধকারে একটি ভাঙাচোরা রেলিং আর সেই প্ল্যাটফর্ম।

 

গল্পের ৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!