অতসীদের কথা— প্রথম পরিচ্ছেদ

অতসী দাঁড়িয়ে আছে এক্সাইড হাউসের মোড়ে। যেখানে হলদিরামের দোকান, তার সামনে। নীলরঙা শিফন শাড়ীতে। অফিস কেটেছে অতসী। অতসী দেখতে মোটামুটি। শ্যামলা, সামান্য স্থূলকায়া। এখন সকাল এগারোটা। বাসে অফিসযাত্রীর ভীড় এখনো পুরো মাত্রায়। সরকারী চাকুরেদের বাজার,ছেলে-মেয়েদের স্কুল, পাড়ার গলির মুখে প্রাত:কালীন গুলতানি, রুটি-ভাত-চচ্চড়ির আহার সেরে এটাই অফিস যাওয়ার আসল সময়। খিদিরপুরের দিক থেকে শিয়ালদা রুটের বাস-মিনিবাসগুলো হুড়মুড়িয়ে এসে দাঁড়াচ্ছে, ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় জটলা করা মানুষের ভীড়ে। তেলচিটে গেঞ্জি আর হাঁটু ছেঁড়া প্যান্ট পড়া, পঁয়তাল্লিশ কিলো ওজনের হেল্পাররা, ফুটবোর্ড থেকে লাফিয়ে নেমে চিলচিৎকার জুড়েছে &হয়ষঢ়;বেগবাগান-বেগবাগান-শ্যল্‌দা-শ্যল্‌দা-মোল্লাআআলি-ই-ই’। অতসী ভাবে, মিনিবাসের হেল্পারদের একটা ব্র্যান্ড ইমেজ আছে। বয়স ১৮ থেকে ৫০। ওজন কিছুতেই চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ কিলোর বেশী নয়। গলার হনু অস্বাভাবিক বড়। গলার জোর, বিশ্বকর্মা পুজোর ফাটা মাইকের চেয়ে-ও বেশী। বাসের গায়ে যেকোনো জায়গায়, টিকিটিকির মতো লেপটে থাকার ক্ষমতা, এমনকি মনে হয় বাসের তলাতে-ও। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের ভরদুপুর রোদে রাস্তার গরম-গলিত পিচে অবলীলায় খালি পায়ে হেঁটে বেড়ানোর ক্ষমতা-ও।
অতসী দাঁড়িয়ে আছে, স্বপ্ননীলের অপেক্ষায়। অতসী মধ্যতিরিশ। বিপিও কর্মী। নিবাস, দু-কামরার ভাড়ার, মহিলাদের মেসবাড়ীতে, ভবানীপুরে, আরো দুজন মধ্যবয়সিনীর সাথে, গাঁজাপার্কের পাশের গলিতে। বাবা-মা থাকেন সোদপুর। বাবা-মার কাছে আর যাওয়া হয় না, চারবছর, চারবছর আগে, অশোকের সঙ্গে শেষ বোঝাপড়ার পর থেকে, আগের চারবছরের দু:সহ দমবন্ধ করা জীবনের পর থেকে। অতসী এখন স্বাধীন। ফিরে গেছে কলেজ জীবনের আড্ডায়, পুরোনো কিছু বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ রয়ে গেছে এখনো। একঘেয়ে বিকেল আর সপ্তাহান্ত কেটে যায় নন্দন চত্বরে, বা কফিহাউসে । বন্ধুরা কেউ-কেউ সময় দেয়, যাদের উদ্ব্‌ত্ত আছে। অতসীর মত মেয়েরা একা তো নয়ই আজকাল। অনেক মেয়েদের ভীড়ে অতসী শুধু একটা নাম। তাই সময় কাটানোর অভাব হয় না কাজের বাইরে। অতসী এখন, আবার আগের মতো, সিনেমা দেখে নন্দনে আবার প্রিয়াতেও। থিয়েটার দেখে অ্যাকাডেমিতে আর রঙ্গনাতেও। অতসী এখন, আবার, ব্রিটিশকাউন্সিল যায় বা ইউএসাইএস-ও। কলেজ জীবনের উদ্যোগ,স্বপ্ন আর সুযোগটা মরে গেছে, তবু ছুঁয়ে দেখা যায় কিনা চেষ্টা করে। অতসী আবার, ফুচকা খায়, সেই আগের মতো। অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির তেঁতুল জলে ধোয়া আর শতছিন্ন ন্যাকড়া মোছা হাতে ফুচকাওয়ালা আলু-ধনেপাতা-শুকনোলঙ্কার গুঁড়ো মাখে। অতসী জিভের পেছনে খুঁজে চলে পুরোনো ফুচকার স্বাদ।
স্বপ্ননীল, অতসীর আপিসের সহকর্মী। বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। সাধারণ ছেলে। স্বপ্ননীল নন্দনে যায় না। ব্রিটিশকাউন্সিল বা ইউএসাইএস-ও যায় না। অ্যাকাডেমিও যায় না। খবর রাখে না গৌতম হালদার বা ব্রাত্য বসুর নাটকের । বা খবর রাখে না কবে মারা গিয়েছেন পরিতোষ সেন। বিকম পাশ, পাড়ার কম্পিউটার স্কুলে ছমাসের যাতায়াত আর পার্টির মাতব্বর দাদাদের হয়ে বেগার খেটে চাকরিটা জুটিয়ে নিয়েছে। দুই দাদা, দুজনেই রাজ্য সরকারের কেরানী, বাবাও তাই ছিলেন, অবসর নিয়েছেন। আগরপাড়ার জলা জমি বুজিয়ে একটা বাড়ী করেছেন বাবা সারা জীবনের সঞ্চয় জড়ো করে। রাজমিস্ত্রিরা নিজের মতো করে করে দিয়েছে বাড়ীটা, দুটো ঘর উঁচু, দুটো নীচু, আধাতলা সিঁড়িকোঠা, উঠোন কলতলা। তবে ছেলেদের জন্য আলাদা আলাদা ঘর আছে, বড় দুজন বিবাহিত, স্বপ্ননীলের এবারে বিয়ে হবে। তো, স্বপ্ননীল নামটা বেশী কাব্যিক শোনাচ্ছে এই পরিবেশে, নাকি ? সে আর কি করা যাবে। সাধারণ গল্পের চরিত্রের নামও যে সাধারণ হতে হবে এরকম কোনো কথা নেই। আর এরকম স্বপ্ননীলেরাও অনেক ভীড়ে মিশে আছে এখানে-ওখানে।
অতসী আজ স্বপ্ননীলের সঙ্গে যাবে হীরাবন্দরে। লোকাল ট্রেনে। শিয়ালদহ দক্ষিণ থেকে ট্রেন ধরে ওরা। অতসীর সাধারণ চোখে, স্বপ্ননীলের সাধারণত্ব বেঁধে ফেলেছে। অতসী প্রেম চায়। আগের মতো, যেমন চাইতো। সেই ফুচকার স্বাদের মতো। স্বপ্ননীল হারিয়ে গেছে কুটোর মতো। স্বপ্ননীলের ভয় করে, কিন্তু নেশা ধরে গেছে। চাংওয়ার পর্দা ঢাকা কেবিন বা শেষসন্ধ্যায় ফাঁকা অফিসের ঘনিষ্ঠতা শিরায় শিরায় আগুন ধরিয়ে দেয়। ডায়মন্ডহারবার লোকালে ভীড়। নভেম্বরেও কামরার ভেতরে গুমোট গরম। স্বপ্ননীল দরজায় দাঁড়ায়, পেছনে অতসী। স্বপ্ননীলের পেছনের চুল থেকে এক ফোঁটা স্বেদবিন্দু গড়িয়ে আসে শিরদাঁড়া বেয়ে। অতসী দেখে, স্বপ্ননীলের সস্তার টিশার্ট আর সস্তার জিনসের ভেতরে সেই স্বেদবিন্দুটা। অতসী প্রেম চায়। স্টেশনের বাইরে মাঝবয়সী পান খাওয়া রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞাসা করে, &হয়ষঢ়;কোথায় যাবেন ? &হয়ষঢ়;মহুয়া’ না &হয়ষঢ়;সুপ্তি’ ?’, চোখের কোণায় ফিচেল হাসি। রিক্সায় ওরা বসে আঁট হয়ে। স্বপ্ননীল হাওয়া ওড়ে, স্বপ্ননীল প্রেম চায়। চারপাঁচটা ১৮-১৯ বছরের ছেলে, রিক্সা থামিয়ে চাঁদা চায়, শেতলা পুজোর। স্বপ্ননীল পাঁচটাকা দিতে চাইলে, তেড়ে আসে, খিস্তি করে। অতসী তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে পঞ্চাশটাকা দিয়ে দেয়। স্বপ্ননীল ঝগড়া করে, অতসী ঝমেলা থেকে মুক্তি চায়। অতসী প্রেম চায়। মহুয়া হোটেলের খাতায় নামধাম লেখে অতসী। কাল্পনিক। হোটেলের ঘরে জল দিয়ে যায় বাচ্চা চাকরটা। আর ভাতমাছ দুই প্লেট। রিক্সাওয়ালা বলে &হয়ষঢ়;বিকালে আসব নাকি ? স্টেশনে ফিরবেন তো?’। অতসী দরজা বন্ধ করে। স্বপ্ননীল ভয়ে কাঁপে, হিসিয়ে ওঠে, অতসী হাসে, তারপর দুজনেই হারিয়ে যায়।
পরের সপ্তাহেই স্বপ্ননীল ধরা পড়ে যায়, বাড়ীতে, জানাজানি হয়ে যায় সম্পর্কটা। স্বপ্ননীল লড়াই করে। বাড়ীর সাথে, অতসীর সাথে, নিজের সাথে-ও। এ লড়াই বাঁচার লড়াই নয়, ভেসে ওঠার। অতসী কিছুই বলে না। সঙ্গে থাকার অঙ্গীকার-টঙ্গীকার-ও করে না। অতসী শুধু প্রেম চায়। শেষে স্বপ্ননীল হেরে যায়। চাকরি ছাড়ে, বাবার আর পার্টির তদ্বিরে অন্য চাকরী পায়, স্বপ্ননীলের জন্য এবার সত্যি পাত্রী খোঁজা শুরু হয়। অতসী আবার প্রেম খোঁজে, ফুচকা খায়, আলু-ধনেপাতা-শুকনোলঙ্কার গুঁড়ো মাখা।
****

গল্পের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!