ওয়াইস কুরণীর ইন্তেকালের কারামত
জনৈক বুজুর্গ বলেন, আমরা ইরাক থেকে মক্কা ও মদীনায় যাওয়ার ইচ্ছা করি।
আমাদের কাফেলাতে প্রচুর লোক ছিল। ইরাকীদের মধ্য থেকে এক লোক আমাদের সম্মুখে আসে এবং আমাদের সাথী হয়ে চলতে থাকে। লোকটির গায়ের রং ছিল বাদামী। অধিক পরিমাণ ইবাদাত করায় দেহের রক্ত শুকিয়ে গিয়েছিল। নানা রঙের কাপড়ে তালি দেওয়া পুরাতন কাপড় পরিহিত ছিলেন, হাতে ছিল লাঠি। অপর হাতে একটি থলের মধ্যে পাথেয় ছিল।
বর্ণিত আছে, লোকটি ছিলেন ওয়াইস কুরণী। তাঁর এ অবস্থা দেখে কাফেলার কেউ তাঁকে চিনতে পারছিল না। তারা তাঁকে বলতে থাকে যে, আমরা ধারণা করছি বোধ হয় তুমি গোলাম? তাঁরা বলল, আমরা মনে করি তুমি এক গুরুত্বপূর্ণ গোলাম, স্বীয় মনিব থেকে পালিয়েছে। তিনি তাঁদেরকে হ্যাঁ বললেন, তারা তাঁকে বলে যে, তুমি যখন তোমার মনিব থেকে পালিয়েছ তখন নিজেকে কেমন মনে হচ্ছে। আর এখন তোমার কি অবস্থা? তুমি তার কাছে থাকলে তো তোমার এ অবস্থা হত না। ঘটনা দৃষ্টে মনে হয়, তুমি একজন অপরাধী গোলাম। তিনি তাদেরকে বললেন, আল্লাহর কসম আমি অপরাধী গোলাম নই। আমি যদি তাঁর আনুগত্য করতাম এবং তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করতাম তাহলে আমার এ অবস্থা হত না।
অতঃপর তিনি কাঁদতে শুরু করলেন, তিনি এতই কাঁদলেন যে, তাঁর রুহু বের বহার উপক্রম হল। বর্ণনাকারী বুজুর্গ বলেন, লোকেরা তাঁর প্রতি দয়া পরবশ হল তাঁরা বুঝে নিল তিনি দুনিয়ার কোন মনিবের গোলাম অথচ তিনি মনিব বলতে মহান আল্লাহ তা’আলাকে বুঝায়েছেন। কাফেলার এক ব্যক্তি তাঁকে বলে, তুমি ভয় পেয়ো না। আমি তোমার মনিবের কবল থেকে নিরাপত্তা দেব। তুমি তাঁর নিকট গিয়ে ক্ষমা চাও। তিনি বললেন, আমি তো তাঁর কাছে যেতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত এবং তাঁর নিকট যা আছে সেগুলোরই আকাংখী আমি। বর্ণনাকারী বলেন, হযরত ওয়াইস কুরণী নবি করিম (সাঃ) এর রওজা মোবারক যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনায় যাচ্ছিলেন।
অতঃপর কাফেলাটি সেদিনই রওয়ানা হয়ে খুব দ্রুত বেগে যেতে থাকে। সন্ধার ঘনিয়ে তাঁরা মরুভূমিতে যাত্রা বিরতী করে। সে রাতেই প্রবল বর্ষণ হয়।
বর্ণনাকারী বলেন, কাফেলার সকলেই নিজ নিজ তাবুতে আশ্রয় গ্রহণ করে অথচ হযরত ওয়াইস কুরণী কোথাও ঠাই হল না। তিনি কারো কাছে আশ্রয়ও চাননি। তিনি কারো কাছে আশ্রয় না চাওয়ার কারণ হল , তিনি মনে করতেন, জাগতিক ব্যাপারে কোন মাখলুকের কাছে কেন চাইব? মুখাপেক্ষীদের যাবতীয় প্রয়োজন তো সব আল্লাহই পূর্ণ করবেন।
সে রাতে হযরত ওয়াইস কুরণীর এতই ঠান্ডা লাগে যে, তাঁর সারা শরীল কাঁপতে থাকে। প্রচণ্ড শীতের কারণে তিনি মাঝ রাতে ইন্তেকাল করেন।
সকাল বেলা কাফেলা রওয়ানা হয়ে যাবে। এমন সময় একজন বলল, ওহে উঠুন কাফেলা চলে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি কোন সাড়া দেননা, লোকেরা তাঁর কাছে এসে তাঁকে নাড়া দিয়ে বুঝতে পারল তিনি আর নেই আল্লাহ পাক তাঁর উপর দয়া করেছেন। সে ডেকে বলল, হে কাফেলার লোকেরা।
যে লোকটি তাঁর মনিব থেকে পালিয়ে এসেছিল সে মারা গেছে তাঁকে দাফন না করে চলে যাওয়া তোমাদের উচিৎ হবে না। লোকেরা বলল, এছাড়া আরকিবা করার আছে? যুবক লোকটির সাথে অন্য একজন নেক্কার লোকছিল। সে বলছিল লোকটি তাওবাহকারী ছিল সে তাঁর মাওলার আশেক ছিল। সে গুনাই যাই করেছে সেজন্য লজ্জিত ছিল। আমি আশা করি তাঁর কারণে আল্লাহ পাক তাঁর তওবাহ কবুল করেছেন। তাঁকে দাফনের ব্যবস্থা না করে চলে গেলে আমার ভয় হচ্ছে এজন্য জবাবদিহি করতে হবে। এখন কবর খনন করা তোমাদের জন্য উচিৎ। এতে তাঁকে দাফন করতে একটু ধৈর্য ধারণ কর। তাঁর বলল, এটি এমন এক স্থান যেখানে পানি নেই।
সে বলল, তোমাদের এবং পানির ব্যবধান অতি অল্প। তোমাদের কেউ আমার সাথে চল আমি পানির ব্যবস্থা করব। এক জনে পানির পাত্র নিয়ে পানির সন্ধানে বের হতেই সে এক কূপের পাশে দাড়াল। তখন সে বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে বলতে লাগল, কি আশ্চর্য এর কোন উপমা খুজে পাচ্ছি না। এটি এমন এক জায়গা সেখানে কোন পানি ছিল না। এমন কি এর আশেপাশে কোন পানির নাম গন্ধ ছিল না। লোকটি এসেই বলতে লাগল তোমাদের কষ্ট দূর হল তোমরা নাকড়ী সংগ্রহ কর। অতঃপর প্রচণ্ড শীতের প্রকোপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য তাঁরা লাকড়ী সংগ্রহ করে পানি গরম করতে গিয়েই দেখল পানি গরম হয়ে আছে। এতে তাদের বিস্ময়তাঁর সীমা রইল না এবং সকলেই ভয় পেতে থাকে। অতঃপর তাঁরা পরস্পর বলাবলি করতে থাকে যে, লোকটির কাহিনী বড়ই চমৎকার।
বুজুর্গ লোকটি বর্ণনা করেন, কাফেলার লোকেরা তাঁর কবর খনন করতে শুরু করল।
তুলনামূলক নরম পেতে থাকে এবং মাটি থেকে মৃত নাভির সুঘ্রান পাচ্ছিল। তাঁরা দুনিয়ার কোন সুঘ্রাণই এর মত পাচ্ছি না। সুতরাং তখন তাদের ভীতি আরো বৃদ্ধি পেল। যখন তাঁরা কবর থেকে উত্তোলিত মাটি দেখছিল তাঁর (ওয়াইস কুরণীর) দেহের রঙের ন্যায় দেখতে পাচ্ছিল এবং ঘ্রান নিতেই মৃগানাভির সুঘ্রান পেত।
তখন কাফেলার লোকেরা হযরত ওয়াইস কুরণীর জন্য একটি তাবুর ব্যবস্থা করে তাতে তাঁকে রেখে দেয়। কে তাঁর কাফন করবে এ নিয়ে তাদের মাঝে দোস্তর মত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। একজন বলে আমি কাফন দেব অপরজন বলে আমি দেব। অতঃপর তাঁরা একথার উপর ঐকমতো পৌঁছে যে প্রত্যেকেই একটি করে কাপড় দেব। অতঃপর তাঁরা কালি ও কাগজ এনে তাঁর আকৃতি (ছবি) তৈরি করে বলে যে, আমরা মদীনায় গেলে আশা করি কেউ না কেউ তাঁকে চিনতে পারবে এবং তারা তাঁর মালামালের উপর অংকিত ছবিটি রেখে দিল।
অতঃপর তারা যখন তাঁকে গোছল দিয়ে কাফন পরাতে উপস্থিত কাপড় সরাল তখন দেখা গেল তিনি জান্নাতের কাফন পেয়ে গেছেন। তাঁর কাফনে মৃগ নাভী ও আম্বর লাগানো ছিল।
বিস্ময়ে তারা লা হাওলা ওয়ালাকুইয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিন আযীম পাঠ করলেন। আল্লাহ পাক স্বয়ং তাঁর কাঁফন পরিয়ে দিলেন। বান্দাদের কাফন থেকে তাঁর অমুকপেক্ষী করে দিলেন। আমরা আশা করি এই নেক বান্দার খেদমতের কারণে আমাদেরকেও জান্নাত দেয়া হবে। আর এই নেক্কার বান্দাকে অরক্ষিত অবস্থায় প্রচণ্ড শীতের মধ্যে রাখার কারণে তাঁরা অত্যন্ত লজ্জিত হল। যে কারণে তাঁর ইন্তেকাল হয়।
অতঃপর তারা তাঁকে দাফন করতে উঠিয়ে অপেক্ষাকৃত একটি নরম স্থানে রেখে দেয় তাতে তাঁর নামাযের জানাযা পড়া যায়। জানাযায় তাঁরা তখন আল্লাহু আকবর বলে তখন আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম তাকরীবের আওয়াজ শোনা গেল। এতে তাদের কলিজা ও চোখ ফেটে যাওয়ার উপক্রম হল এবং ভীষণ ভয়ের কারণে ও মাথার উপর তাকবীর ধ্বনির আওয়াজের ভয়ে তাঁরা কিভাবে তাঁর জানাযা শেষ করবে তা বুঝতে পারছিল না।
এরপর তারা তাঁর লাশ কবরে নিয়ে যেতে উঠাল এমন মনে হয় যে তাদের থেকে তাঁকে আগলে ধরে নেয়া হচ্ছে। তারা তাঁর কোন ভার অনুভব করছিল না। এমন ভাবে তাঁকে দাফন করা হল এবং কাফেলার লোকেরা তাঁর এ অলৌকিক ব্যাপারে আশ্চার্যান্বিত হল।
অতঃপর তাঁরা যখন মসজিদে কুফাতে আসে এবং তাঁর (ওয়াইসকরণী (রাঃ এর) আকার আকৃতি ও ঘটে যাওয়া ঘটনা বর্ণনা করে তখন কুফার মসজিদে কান্নার রোল পড়ে যায। এ অবস্থা না হলে তাঁর মৃত্যু সংবাদ কেউ জানতই না এবং তাঁর কবরের খোঁজ পেত না। কেননা, তিনি নিজেকে লোকালয় থেকে লুকিয়ে রাখতে বা মানুষ থেকে পালিয়ে থাকতেন। মহান আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রতি সন্তুষ্টি হয়েছেন তাঁর বরকতে আমাদেরকেও বরকতময় করুন।