গল্পের ভূত–আরমান হায়দার

গতকাল রাতে একটা ভূত এসেছিল। সেই ভূতের কি লাল আগুনের মতো চোখ! স্কুলের ব্লু্যাকবোর্ডের চেয়েও কালো মুখ। সমস্ত শরীরে শুধু কংকাল আর কংকাল; সাদা হাড়-হাড্ডিতে গড়া কংকাল। অতনুর মামা এই বলে গল্পটা কেবলই বলতে শুরু করেছিল। কিন্তু অতনু বিছানা থেকে উঠে ঝিম মেরে বসে থাকলো, মনে হচ্ছে গল্পটা তার পছন্দ নয়। অথবা এমনও হতে পারে গল্পের ভূতটি তার নিজেরই ঘাড়ে চেপে বসেছে। তবে এ ঘটনা দুটোর যাই ঘটুক না কেন, অতনুর মামার কাছে তা ভালো ঠেকলো না। মামা কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেন।

অতনুকে মায়ের বিছানা থেকে পৃথক বিছানায় ঘুমানোর অভ্যাস করানোর জন্য তার মামা প্রতিদিন রাতে তিনটি করে গল্প বলে থাকেন। এর মধ্যে একটি ভূতের, অন্যটি রাজাদের হরিণ শিকার নিয়ে; আর শেষেরটি চালাক শিয়াল ও বোকা কুমিরদের নিয়ে গল্প।

তবে শেষের চালাকি-বোকামির গল্পটি প্রায়ই অতনুর শোনা হয় না। কেননা অতনু ততোক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ে। তাই অতনুর চালাক হয়ে ওঠা আর হচ্ছে না। সে ভূতের গল্পেই মজা পায়, বিশ্বাস করে। কিন্তু আজকে কেন যে অতনু এমন করছে তার কোনো কারণ খুঁজে পান না মামা।

মামা বলেন – ‘কিরে অতনু! তোর আজ হলোটা কি?’

অতনু গম্ভীর মুখে বসেছিল। ইদানীং বেশ কিছুদিন হলো বিজ্ঞানের বইপড়ার কারণে তার মনোজগতে পরিবর্তন এসেছে। হয়তো এ কারণেই আজকে তার মামার গল্পের মধ্যে সে কোনো ভূত দেখতে পেলো না। সে দেখতে পায় মামার বোকামি। সে মুখের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো- ‘আচ্ছা মামা বলতো! যখন ভূতটি এসেছিল, তখন রুমে আলো জ্বলছিল কিনা?’

– ‘তুই তো আচ্ছা বোকারে অতনু! এটা আবার একটা প্রশ্ন হলো? ভূত কি কখনো আলোর মধ্যে আসে? এ পর্যন্ত যতো ভূতের গল্প বলেছি তাতে কি আলো ছিল?’ একটু থেমে মামা আবার বলেন- ‘আসলে ভূত আসে অন্ধকারে। গতরাতেও ভূতটা এসেছিল গভীর রাতে, মিশমিশে কালো অন্ধকারে। তুই তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলি। হঠাৎ করেই ভূতটি এসে বললো, অতনুটা তাহলে ঘুমিয়ে গেছে, ভালোই হয়েছে।

তোমার সঙ্গেই তাহলে গল্প করি। বলেই সাদা বড় বড় দাঁত বের করে হাসলো ভূতটা।’

– ‘ভূতের দাঁত যে সাদা, তুমি অন্ধকারে তা দেখলে কিভাবে?’ অতনু বড়দের মতো নির্বিকারভাবে প্রশ্নটি করলো। প্রশ্ন শুনে, বুদ্ধির বহর দেখে মামা যেন এবার আকাশ থেকে মাটিতে পড়েন; বলতে থাকেন- ‘বিশ্বাস করিস্ নে! ভূতের দাঁত সাদা। তুই তো দেখছি একটা আস্ত গাধা। ভূত কালো, চোখ দুটো লাল। তুই এটা জানিস নে! তোর এ কি হয়েছে হাল!’

– ‘আমার হাল-হকিকত ঠিকই আছে মামা। তুমি আসলে ভূত দ্যাখোনি। আর দেখলেও স্বপ্ন দেখেছো। গতকাল রাতে ভূত এসেছিল কিনা আমার সন্দেহ আছে।’

– ‘কেন, সন্দেহ থাকতে যাবে কেন?’ ভারী আশ্চর্য কণ্ঠে বলেন মামা।

– ‘তোর তো ভূতের প্রতি যাচ্ছেতাই অবিশ্বাস! বিষয়টি তো ভূতকে জানাতে হয়। দেখিস! ওরা কিভাবে তোর ঘাড় মটকে দেয়।’

ঘাড় মটকানোর কথা শুনে এবার অবশ্য কিছুটা হলেও ভয় পায় অতনু। সে নড়েচড়ে বসে বলে- ‘না মামা ভূতে আমার অবিশ্বাস নেই। তবে ভূতের যে চোখ লাল, মুখ ব্লু্যাকবোর্ডের মতো কালো আর দাঁত ধবধবে সাদা; এই সব বিষয়ে কিছুটা সন্দেহ আছে।’

অতনুর কথা শুনে মামা যেন এবার বেশ খানিকটা থমকে গেলেন। চিন্তিত মুখে বলেন- ‘তোর এ রকম সন্দেহের কারণ?’

– ‘কারণ খুব সোজা। রাতের অন্ধকারে সব রঙই দেখতে কালো। বিজ্ঞানীরা বলেন, অন্ধকারে কোনো রঙই চেনা যায় না। তা তুমি কিভাবে লাল, কালো, সাদা রঙ দেখতে পেলে?’

অতনুর মামা এবার সত্যি সত্যি ভাবনায় পড়ে যান। তার এই এতোটুকুন ভাগ্নে বলে কি! ওর এতো বুদ্ধি হলো কিভাবে? ওকে তো চালাক শিয়ালের গল্পটা তেমন বলাই হয় না, তার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে। তাহলে নিশ্চয়ই বিজ্ঞানের বই পড়ে পড়ে এসব জ্ঞান হয়েছে। অন্ধকারে যে সব রঙই কালো, গল্প বলার সময় এ বিষয়টি তার মাথায়ই আসেনি। আসলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা না করে আজকালকার যুগে গল্প বলাও কঠিন।

যাই হোক, ভাগ্নেদের কাছে এসব ব্যাপারে তো আর হার মানা যায় না। তা হলে তার মতো মামারা বুক ফুলিয়ে, ঘাড় দুলিয়ে, বুদ্ধি খেলিয়ে গল্প বলবে কিভাবে? তাই দমে না গিয়ে মামা এবার বলেন- ‘ঠিক আছে তোর কথা যে ঠিক তার প্রমাণ তোকে দিতে হবে। নইলে গত রাতের একটা জলজ্যান্ত ভূতের স্যাঙাৎকে মিথ্যা বলার অপরাধে ভূতকে দিয়ে তোর মাথার বাম পাশের চুল রেখে ডান পাশের চুল ন্যাড়া করে দেবো। তখন দেখবি স্কুলের বন্ধুরা তোকে নিয়ে কেমন মজা করে।’ বলেই অতনুর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকেন মামা।

তারপর জিজ্ঞাসা করেন- ‘কি রাজি? হু-হু এটা বিজ্ঞানের ভূত নয়, গল্পের ভূত।’

অতনু যেদিন বিজ্ঞান বই থেকে এ তথ্যগুলো পড়েছিল, সেদিনই সে একটি এক্সপেরিমেন্ট করে।

বই রেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে বিজলী বাতির সুইচ অফ করে দেয়।

ঘুটঘুটে অন্ধকারে সে আয়নাও দেখতে পায় না, তার নিজের সাদা দাঁতও দেখতে পায় না। তার বালিশের লাল কভারটি, বিজ্ঞান বইয়ের সাদা পাতাটি সবই দেখতে আঁধার-কালো। তাই বিজ্ঞানের কথাগুলো যে সত্যি, সে ব্যাপারে তার হাতে প্রমাণ আছে। ইচ্ছে করলে সে তার মামাকে প্রমাণটি দেখাতেও পারে। কিন্তু মামার শেষের কথাটির মধ্যে সন্দেহের একটু গন্ধ আছে; হু-হু এটা বিজ্ঞানের ভূত নয়, গল্পের ভূত।

অতনু ভাবলো, হতেও তো পারে বিজ্ঞানের ভূত আলাদা, গল্পের ভূত আলাদা। তাছাড়া গল্পের ভূত যদি থেকেই থাকে, তাহলে মাথা ন্যাড়া হবার ভয়ও আছে। অর্ধেক মাথা ন্যাড়া! উহ্ কি বিচ্ছিরি হবে। তার চেয়ে মামার সঙ্গে থেকে ভূতের গল্প শোনা এবং সম্ভব হলে গল্পের ভূতটাকে একবার দেখতে পারলে মন্দ হয় না। তাই অতনু তার মুখের গোমরা ভাবটি সরিয়ে নিয়ে সেখানে আগ্রহের ভাব জাগিয়ে তুলে

বলে- ‘আচ্ছা মামা বলোতো! কাল রাতে ভূত এসে কি বললো?’

এবার মামার মুখে বিজয়ের হাসি। তিনি সমস্ত মামা জাতিকে বিজ্ঞান পড়–য়া ভাগ্নেদের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন। মামা বললেন- ‘কি এতোক্ষণে তা হলে ভূতের ওপর ভক্তি এসেছে!’ একটুক্ষণ থেমে মামা বিজ্ঞের মতো বললেন-‘শোন অতনু!

আসলে বিজ্ঞান যেমন সত্যি, তেমনি ভূতের গল্পও যে মিথ্যা এমনটা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না। এই যেমন তুই বললি, অন্ধকারে কোনো রঙই বোঝা যায় না।

এ কথাটিও সবক্ষেত্রে ঠিক না। রাতের আঁধারে লাল আলো জ্বাললে লালই দেখা যায়, আবার সবুজ জ্বাললে সেটাও দেখা যায়। কারণ ওগুলোতে শক্তি আছে। তাই আসল কথা হলো শক্তি। ভূতও তার অদৃশ্য শক্তি নিয়ে হাজির হলে তার লাল চোখ, সাদা দাঁত, কালো মুখ দেখাতে পারে।’

মামা আরো কী সব বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অতনুর আর ধৈর্য মানছিল না। তাই সে বললো- ‘সবই বুঝলাম মামা, কিন্তু গতকাল রাতে ভূত এসে কী করলো, কী বললো সেটা বলো।’

– ‘সেটাই তো বলছি। কাল রাতে যেই না তুই ঘুমিয়ে পড়েছিস, ওমনি লাল চোখের কালোমুখো ভূতটি এসে বসলো আমার বিছানার পাশে…।

গল্প শুনতে শুনতে অতনু তার মামার আরো কাছাকাছি এসে বসে। আর মামা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বুক ফুলিয়ে, ঘাড় দুলিয়ে, বুদ্ধি খেলিয়ে গল্প বলে চলেন।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!